March 9, 2025 8:36 pm
March 9, 2025 8:36 pm
Home Featured প্রিমিয়ামসহ ইফাদ অটোসের আইপিও: ব্যর্থতা নাকি স্মার্টলি সাজানো প্রতারণা!

প্রিমিয়ামসহ ইফাদ অটোসের আইপিও: ব্যর্থতা নাকি স্মার্টলি সাজানো প্রতারণা!

by fstcap

এক সময় সম্ভাবনার উজ্জ্বল তারকা ছিল ইফাদ অটোস। ২০১৫ সালে ১০ টাকা ফেস ভ্যালুর সঙ্গে ২০ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের মাঝে প্রবল উচ্ছ্বাস ছিল। তখনকার হিসাব অনুযায়ী, কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৫ টাকারও বেশি। বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন, এটি হবে দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক একটি বিনিয়োগ। কিন্তু আজ সেই ইফাদ অটোসই বিপন্ন শেয়ারে পরিণত হয়েছে।

২০১৫ সালে যে কোম্পানিটি ছিল বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আইপিওতে থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে ইফাদ অটোস নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের ঘোষণা দেয়, যা বিনিয়োগকারীদের মনে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই আশা আজ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। এক সময়ের এই প্রতিশ্রুতিশীল কোম্পানি এখন লোকসানের গভীর খাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

কোম্পানিটি এখন টানা লোকসানের ফাঁদে আটকা পড়েছে।েএ কারণে বিনিয়োগকারীদের কোনো ডিভিডেন্ড পর্যন্ত দেয়নি। অবস্থা এতোটাই খারাপ যে, বর্তমান দর অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের আসল টাকা ফেরত পেতে ৫০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে! প্রশ্ন হলো, যেই কোম্পানি এক সময় বাজার কাঁপিয়েছিল, সেই কোম্পানিটি আজ এতোটা ধ্বংসের মুখে পড়ল কীভাবে?

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো- কোম্পানির রিজার্ভে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা থাকার পরও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি। প্রশ্ন উঠছে—কোম্পানি যখন বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে সক্ষম, তখন কেন বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা হলো?

ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে দেখা গেছে, কোম্পানিটির রিজার্ভে ৫৯৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা থাকা সত্ত্বেও সদ্য বিদায়ী বছরে (৩০ জুন ২০২৪) বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত ডিভিডেন্ড দেয়নি কোম্পানিটি। এর আগের বছর নামমাত্র ২ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে, যার মধ্যে ১ শতাংশ ক্যাশ ও ১ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড।

সাধারণত একটি কোম্পানির মুনাফা থেকে রিজার্ভ গড়ে ওঠে, আর সেই রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়া হয়। কিন্তু ইফাদ অটোসের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি করেছে।

অন্যদিকে, কোম্পানিটি গত দুই বছর টানা লোকসান করছে এবং ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ইফাদ অটোসের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণের পরিমাণ ৬৬ কোটি টাকারও বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কোম্পানি লোকসানেই থাকে, তাহলে কীভাবে তাদের রিজার্ভ ৫৯৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকায় পৌঁছালো? এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কি সত্যিই কোম্পানির তহবিলে আছে, নাকি কাগজে-কলমে শুধু সংখ্যা দেখানো হচ্ছে?

তথ্য বিশ্লেষণে আরও জানা গেছে, কোম্পানিটির হাতে বর্তমানে নগদ অর্থ রয়েছে ১১৫ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ৩৪৩ টাকা,  সেখান থেকে সদ্য বিদায়ী বছরে ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ডে বিনিয়োগকারীদের দিলে ইফাদ অটোসের ব্যয় হতো ২৬ কোটি ৮২ লাখ ৫৩ হাজার ৯১১ টাকা। এক্ষেত্রে কোম্পানিটির কাছে আরও ৮৮ কোটি ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪৩২ টাকা অবশিষ্ট থাকতো। অথচ নামমাত্র ২ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

কোম্পানির তথ্য বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, গত দুই বছরে (২০২৩ ও ২০২৪) ধারাবাহিকভাবে লোকসান করেছে ইফাদ অটোস। ৩০ জুন ২০২৩ হিসাব বছরে ইফাদ অটোসের মোট লোকসান হয়েছে ১৫ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫৪২ টাকা, শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ০.৫৮ টাকা। আর ৩০ জুন ২০২৪ হিসাব বছরে লোকসান হয়েছে ১৬ কোটি ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৩ টাকা, শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ০.৬২ টাকা।

কোম্পানিটি জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার ওঠানামা, পণ্য মুদ্রাস্ফীতির কারণে বিনিময়জনিত ক্ষতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার হার বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধির দরুন উল্লেখিত বছরগুলোতে ইফাদ অটোসের নিট ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে ব্যবসা সম্প্রাসারনে গত দুই বছরে কোনো কাজ করেনি কোম্পানিটি। ফলে এই সময়ে ক্যাপিটাল ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস শুণ্যে নেমে এসেছে। সদ্য বিদায়ী বছরে ইফাদ অটোসের শেয়ার প্রতি নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্বক ১.৮১ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ কোম্পানিটির ব্যবসা পরিচালনায় শেয়ার প্রতি আয়ের চেয়ে ব্যয় ১.৮১ টাকা বেশি হয়েছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় এভাবে বাড়তে থাকলে কোম্পানিটি এক সময় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।

এদিকে কোম্পানিটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরারা। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে ৩৩ শতাংশের বেশি। গত বছরের (২০২৪) ২৮ ফেব্রুয়ারি ইফাদ অটোসের শেয়ার দর ছিল ৩৭ টাকা। আর চলতি বছরের (২০২৫) ২৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার শেয়ার দর এসে দাঁড়িয়েছে ২৪.৭ টাকা।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইফাদ অটোসের রিজার্ভের টাকার সঠিক ব্যবহারের পরিকল্পনা নেই। তারা শুধুমাত্র শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়া থেকে বিরত থেকে নিজেদের মূলধন শক্তিশালী করছে, যা বিনিয়োগকারীদের প্রতি চরম অবিচার। অন্যদিকে, শেয়ারবাজারে এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা তুলনামূলকভাবে কম মুনাফা করলেও শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। কিন্তু ইফাদ অটোস কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই বিনিয়োগকারীদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে।

তারা আরও বলেন, এই পরিস্থিতি শেয়ারবাজারের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। একটি কোম্পানি যদি শেয়ারবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে না পারে, তাহলে বাজারে তাদের অবস্থান কতটা নৈতিক ও স্বচ্ছ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উচিত ইফাদ অটোসের আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখা এবং শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

বর্তমানে ইফাদ অটোসের মূল্য আয় অনুপাত এমন পর‌্যায়ে পৌছেছে যে, বিনিয়োগকারীরা যদি বর্তমান দর ধরে রাখেন, তবে মূলধন ফেরত পেতে প্রায় ৫০ বছর সময় লেগে যাবে। যেই শেয়ারে একসময় দ্রুত মুনাফার আশা করা হতো, সেই শেয়ার আজ বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি, কারণ তারা তাদের আসল টাকাই ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না।

ডিএসই’র তথ্য বলছে, অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে ইফাদ অটোস পিএলসি’র বর্তমানে মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ৪৯.৪ পয়েন্ট। ফলে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগের অর্থ ডিভিডেন্ড আকারে তুলে নিতে ৪৯.৪ বছর সময় লাগবে বিনিয়োগকারীদের।

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ রুলস অনুসারে কোনো কোম্পানির পিই রেশিও সর্বোচ্চ ৪০ পয়েন্ট বা তার কম থাকলে সেই কোম্পানির শেয়ার মার্জিন লোন নিয়ে কিনতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু পিই রেশিও ৪০ এর উপরে যাওয়ায় ইফাদ অটোসের শেয়ার মার্জিন লোন নিয়ে কিনতে পারবেন না বিনিয়োগকারীরা।

ইফাদ অটোস আইপিও থেকে ৬৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা বৃদ্ধি করা। কিন্তু বাস্তবে সেই মুনাফা তো বাড়েইনি, বরং কোম্পানিটি ২০১৭ সালে আবারও মূলধন বাড়ানোর জন্য রাইট শেয়ার ইস্যু করে। ২আর:৫ অনুপাতে শেয়ার ছেড়ে আরও অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত বড় আকারের মূলধন সংগ্রহের পরও কোম্পানিটি কেন মুনাফায় ফিরতে পারল না? যেখানে নতুন মূলধনের ফলে ব্যবসায় আরও শ্বাস নেওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা, সেখানে উল্টো কোম্পানিটি ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে ইফাদ অটোসের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণের পরিমাণ ৬৫ কোটি ৮০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অথচ বাজার বিশ্লেষকদের মতে, কোম্পানির আইপিও ও রাইট শেয়ার থেকে সংগৃহীত অর্থ যদি যথাযথভাবে বিনিয়োগ করা হতো, তাহলে এতো বড় ঋণের বোঝা থাকার কথা নয়।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, কোম্পানিটি বাজার থেকে টাকা তুললেও সঠিকভাবে সেই অর্থের ব্যবহার নিশ্চিত করেনি। ফলে কোম্পানির উৎপাদনশীলতা বাড়েনি, বরং পরিচালন ব্যয় বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের মনে প্রশ্ন জাগে- আইপিওর সময় দেখানো আর্থিক সক্ষমতা কি আসলেই বাস্তব ছিল, নাকি তা কেবল আইপিও প্রক্রিয়া সফল করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল?

ইফাদ অটোসের কোম্পানি সচিব মো. সাজ্জাদ হোসেইন তালুকদার এক লিখিত বক্তব্যে বিজনেস জার্নালকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে নগদ প্রাপ্তি হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার হার বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়জনিত ক্ষতির কারণে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্বক ১.৮১ টাকা হয়েছে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় ইফাদ অটোস যে আশার বাণী শুনিয়েছিল, তার সঙ্গে বাস্তবতার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বিনিয়োগকারীরা এখন বলছেন, কোম্পানিটি দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে- এমন মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল।

২০১৫ সালে আইপিওর সময় কোম্পানির সম্পর্কে ইস্যু ম্যানেজারের মূল্যায়ন ছিল চমকপ্রদ, কিন্তু এখন সেই মূল্যায়ন পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ২০১৭ সালে রাইট শেয়ার ইস্যুর পরও কেন কোম্পানির আর্থিক অবস্থা আরও দুর্বল হলো? কোম্পানির শেয়ারের দর এমন অবস্থায় নেমে এসেছে যে বিনিয়োগকারীরা তাদের আসল টাকাও ফেরত পাবেন কি না, তা অনিশ্চিত। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হননি, বরং অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। এটা কি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা নাকি ব্যবস্থাপনার দুর্নীতি?      businessjournal24.com

IPO ifad autos limited bangladesh bd

You may also like