Home Featured সুদহার বাড়ায় চাপে বেশি ঋণের কোম্পানি

সুদহার বাড়ায় চাপে বেশি ঋণের কোম্পানি

by fstcap

ঋণের সুদহার বছর তিনেকের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশে বেঁধে রাখার পর সেটি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তুলে দেয়া হয়। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে সে হার বাড়তে থাকে।

ঋণের সুদহার বছর তিনেকের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশে বেঁধে রাখার পর সেটি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তুলে দেয়া হয়। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে সে হার বাড়তে থাকে। এটি আরো গতি পায় গত বছরের আগস্টে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর। বেশ কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর পর বর্তমানে ঋণের সুদহার ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ১৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। সুদহারে এ উল্লম্ফনে ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আর বাড়তি এ ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপরও খরচ চাপাচ্ছে কোম্পানিগুলো। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে বাড়ানো সুদহার পণ্যের দামকে আরো উসকে দিতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে যেসব কোম্পানির ঋণের পরিমাণ বেশি, সুদহার বাড়ায় বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে সেগুলো।

দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে যেগুলোর ইকুইটির তুলনায় বেশি ঋণ রয়েছে, এমন বেশ কয়েকটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে বণিক বার্তা। এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে কোম্পানিগুলোর ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সমাপ্ত প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য।

ইকুইটির তুলনায় ঋণ কম থাকা কোম্পানির জন্য ভালো। এক্ষেত্রে ইকুইটির এক গুণ বা তার কম ঋণ থাকা নিরাপদ। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রেটিং প্রতিষ্ঠান ইকুইটির দেড় গুণ পর্যন্ত ঋণকে সহনীয় হিসেবে বিবেচনা করে।

ওষুধ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসিআই লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে ৬ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কোম্পানিটির ইকুইটির তুলনায় ঋণ রয়েছে ৮ দশমিক ৫৬ গুণ। গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে তাদের প্রায় ২১৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ১৫৩ কোটি টাকা।

বহুজাতিক ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির ইকুইটির তুলনায় ৫ দশমিক ৯৪ গুণ ঋণ ছিল। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে তাদের আর্থিক ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৯ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৪ কোটি টাকা।

আফতাব অটোমোবাইলস লিমিটেডের ইকুইটির তুলনায় ঋণ রয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ গুণ। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির মোট ঋণ ছিল ১ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। নির্মাণ খাতের কোম্পানি মীর আকতার হোসেন লিমিটেডের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং অন্যান্য দায় মিলিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার ঋণ ছিল। কোম্পানিটির ইকুইটির তুলনায় ঋণের পরিমাণ ২ দশমিক ৯৪ গুণ।

ইস্পাত খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের গত সেপ্টেম্বর শেষে ইকুইটির তুলনায় ঋণ রয়েছে ২ দশমিক ৩৬ গুণ। এ সময়ে কোম্পানিটির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১০ কোটি টাকা। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে কোম্পানিটির ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ ১০২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ৯৫ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মুনাফার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার সুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হয় না, বরং আরো বাড়িয়ে দেয়। সরকারের প্রতি আইএমএফের নির্দেশনা রয়েছে যে সুদহার বাড়িয়ে দিলে মানুষের ভোগ কমে যাবে এবং এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। এটি উন্নত দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেখানে ক্রেডিট কার্ড বা ঋণের মাধ্যমে ভোক্তারা সবকিছু কেনে। সেসব দেশে শিল্পায়ন বা ব্যবসা পরিচালনায় ব্যাংক থেকে কেউ ঋণ নেয় না। বরং পুঁজির জোগান আসে ইকুইটি মার্কেট, বন্ড মার্কেট ও পুঁজিবাজার থেকে। যদিও আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়।’

বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শিল্প-কারখানা করা হয় আবার ব্যবসা চালানোর জন্যও ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় বলে উল্লেখ করেন জিপিএইচ ইস্পাতের এমডি। তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে সুদহার বেড়ে গেলে বাড়তি ব্যয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ করে ভোক্তার ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়। এতে শেষ পর্যন্ত পণ্যের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মুনাফা কমে যাচ্ছে, কেউ কেউ লোকসানও দিচ্ছে। সুদহার বাড়লে শুধু যে বেসরকারি খাতের ব্যয় বাড়বে এমন নয়। এর ফলে সরকারের ঋণের বিপরীতে সুদ ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। আর বাড়তি এ ব্যয় কিন্তু সরকার কোনো না কোনোভাবে জনগণের কাছ থেকেই নেবে।’

সুদহার বাড়ায় বিভিন্নভাবে দেশের অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে এটি কল্যাণকর নয়। আমাদের এখানে ইকুইটি মার্কেট নেই, বন্ড মার্কেটও সে অর্থে নেই। পুঁজিবাজার থাকলেও অর্থনীতির তুলনায় সেটির আকার বেশ ছোট। পুঁজিবাজার বড় হলে শিল্প খাতে পুঁজির জোগানের জন্য ব্যাংকের কাছে যেতে হতো না।’

বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন পিএলসির ইকুইটির তুলনায় ঋণ রয়েছে ১ দশমিক ৯৬ গুণ। গত সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও অন্যান্য দায় মিলিয়ে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তাদের ঋণের সুদ বাবদ ৪৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ২৩ কোটি টাকা।

এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সব খাতেই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়েছে। এ ধাক্কা অনেকের জন্যই সহনীয় পর্যায়ে নেই। সুদহার যেভাবে বাড়ছে তাতে গ্রাহকদের ভোগের পরিমাণ ও ক্রয় সক্ষমতা কমে গেছে। ফলে বর্তমানে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে মুনাফা করার সুযোগ নেই। যতক্ষণ না সুদহার কমছে ততক্ষণ পর্যন্ত নতুন বিনিয়োগ আসবে না। দেশী বিনিয়োগে আস্থা না থাকলে বিদেশী বিনিয়োগও আসবে না। আর নতুন বিনিয়োগ না হলে নতুন করে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না। সব মিলিয়ে আমরা একটি ভয়াবহ পর্যায়ে অবস্থান করছি। এক্ষেত্রে সুদহার কমানো ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই সরকারের কাছে। আমরা আশাবাদী সামনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’    https://www.bonikbarta.com

You may also like