January 20, 2025 2:37 pm
Home Featured লুটেরাদের খপ্পরে নিঃস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারীরা

লুটেরাদের খপ্পরে নিঃস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারীরা

by fstcap

দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিগত সরকারের আমলে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। মালিকপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লুট হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। লুটপাটের সঙ্গে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। এর প্রভাবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের বেশ কয়েক বছর ধরে লভ্যাংশ দিতে পারছে না। একইসঙ্গে এসব কোম্পানির শেয়ারদর কমে একেবারে তলানিতে নেমেছে। তালিকাভুক্ত ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৬টি বা ৬৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিস্থিতি খাদের কিনারায়। এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন দেশের আর্থিক খাতের লুটপাটের চিত্র গোপন রাখা হয়েছিল। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় মালিক ও কর্মকর্তারা মিলে লুট করেছে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা একেবারে নিচে নেমেছে। এখন আর এসব প্রতিষ্ঠানগুলোয় মানুষ আমানত রাখছে না। এছাড়া আগের নামে-বেনামে বিতরণ করা ঋণও এখন আর আদায় করতে পারছে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। তাই স্বাধীনভাবে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলেও মনে করছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এফএএস বা ফাস ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের হার এখন সবেচেয়ে বেশি। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের এক হাজার ৮২০ কোটি টাকা বা ৯৯ দশমিক ৯২ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। ফারইস্ট ফাইন্যান্সের বিতরণ করা ঋণের ৮৭৩ কোটি টাকা বা ৯৮ দশমিক ০৬ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৭৫১ কোটি টাকা বা ৯৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।

আর পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণে এক হাজার ২৬ কোটি টাকা বা হার ৯৭ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপির পরিমাণ তিন হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বা ৯৬ দশমিক ১৯ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের এক হাজার ১৩২ কোটি টাকা বা ৯৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের দুই হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা বা ৮৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৬৬৮ কোটি টাকা বা ৮৭ দশমিক ৮২ শতাংশ, প্রাইম ফাইন্যান্সের ৭৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৭৫ দশমিক ২০ শতাংশ, বে লিজিংয়ের ৬৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্সের ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ, উত্তরা ফাইন্যান্সের ৫৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ, মাইডাস ফাইন্যান্সের ৪৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ইসলামিক ফাইন্যান্সের ৪৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ৪৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। আলোচ্য সবগুলো প্রতিষ্ঠানই দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকেই আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। অপরদিকে নানা সময়ে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার কারসাজি করেছে কয়েকটি চক্র। শেয়ার কারসাজি ও শেয়ারদরে ব্যাপক পতনের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জানা যায়, ২০১৯ সালে গ্লোবাল ইসলামী ও আভিভা ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার ভুয়া কোম্পানি খুলে এফএএস ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ন্ত্রণে নেয়। একপর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না। যে কারণে পিপলস লিজিং, বিআইএফসিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবসায়নের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সেই উদ্যোগ কার্যকর হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠানে মালিকসহ বিভিন্ন পক্ষের যোগসাজশে চরম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের চরম দুরবস্থা। দ্রুত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের নিট আয় বলতে কিছু নেই। তারা ঋণ থেকে যা আদায় হচ্ছে, তা দিয়ে কোনো মতো টিকে আছে। ব্যাপক সমালোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের নিয়ন্ত্রণে ছিল এফএএস ফাইন্যান্স। আর এ প্রতিষ্ঠানটি থেকে ব্যাপক অর্থ লুটপাট করে প্রশান্ত। এক সময় আর আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। অপরদিকে ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত হয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি ৫৪ কোটি ২৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা তুলেছিল। তবে ব্যাপক লুটপাটের কারণে ফাস ফাইন্যান্সের শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারদর কমে মাত্র ৩ টাকা ৩০ পয়সায় নেমেছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত হওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের কোনো বছর নগদ লভ্যাংশ দেয়নি ফাস ফাইন্যান্স।

জানা গেছে, ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে একক নিয়ন্ত্রণ ছিল নিটল-নিলয় গ্রুপের। সেই সময় পর্যন্ত এফএএসের প্রায় ৩৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ছিল নিটল-নিলয় গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির হাতে। ২০১৭ সালে পুরো প্রতিষ্ঠানটি চলে যায় পি কে হালদারের হাতে। এরপর থেকেই অর্থ লুটপাট চলে প্রতিষ্ঠানটিতে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, এক যুগ আগেও দেশের লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো পারফরম্যান্স করছিল। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক লুটপাটের কারণে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে যেখানে ব্যাংক ব্যবসা করতে পারছে না, সেখানে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্যবসা করা তো আরও কঠিন। তালিকাভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান কখনও নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি, আর কখনও পারবেও না। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবসায়ন করার দরকার ছিল। এর মাধ্যমে দায়-দেনা পরিশোধের পর যদি কিছু থাকত তাহলে শেয়ারহোল্ডাররা পেত। মূল বিষয় হলো আমাদের দেশে এখনও প্রতিষ্ঠান অবসায়নের কালচার গড়ে ওঠেনি। এখানে শেয়ারহোল্ডারদেরও দায় রয়েছে। কারণ অনেক সময় তারা কোম্পানি বন্ধ নাকি খোলা তা যাচাই-বাছাই না করেই শেয়ার ক্রয় করে থাকে।

পরিচালকদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কয়েক বছর আগে থেকেই গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছিল না ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। একই কারণে ২০১৭ সাল থেকে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদেরও কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারদর কমে ৩ টাকা ৩০ পয়সায় নেমেছে। এদিকে বিকল্পধারার সাবেক মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের একক উদ্যোগেই বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে মেজর মান্নানের একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে আসছিল। অর্থাৎ তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যাপক লুটপাটও হয়েছে। ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদরও ফেসভ্যালুর নিচে ৮ টাকা ৪০ পয়সায়। বিআইএফসিও তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের কোনো নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

পিপলস লিজিং থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা। পুঁজিবাজারেও এ প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা পুরোপুরি খারাপ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের কোনো নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া শেয়ারদর কমে ২ টাকা ৩০ পয়সায় নেমেছে।
এছাড়া পুঁজিবাজারে অন্য নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। একইসঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে শেয়ার কারসাজির তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে।

প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ারদর ৩ টাকা ৪০ পয়সা, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ৬ টাকা ১০ পয়সা, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ৩ টাকা ৩০ পয়সায়, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৩ টাকা ১০ পয়সা, প্রাইম ফাইন্যান্সের ৪ টাকা ২০ পয়সা, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৩ টাকা ১০ পয়সায়, জিএসপি ফাইন্যান্সে ৫ টাকা ৮০ পয়সায়, মাইডাস ফাইন্যান্সের ৭ টাকা ৮০ পয়সা এবং ইসলামিক ফাইন্যান্সের শেয়ারদর ৯ টাকা ৭০ পয়সায় নেমেছে। আলোচ্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ও উত্তরা ফাইন্যান্সের শেয়ার ফেসভ্যালুর ওপরে অবস্থান করছে। উত্তরা ফাইন্যান্সের শেয়ারদর ১৫ টাকা ২০ পয়সা এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের শেয়ারদর ১১ টাকা ৬০ পয়সায় অবস্থান করছে। তিন-চার বছর ধরে এ কোম্পানি দুটিও লভ্যাংশ দিতে পারেনি।    https://sharebiz.net

 

bangladesh investor bangladesh sharemarket

You may also like