চাহিদা না থাকলেও ২০১৭ সালে জরুরি ভিত্তিতে ছয়টি বড় ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন করে সরকার। এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার এসব কেন্দ্র বেশিরভাগ সময়ই বসে থাকত। পাঁচ বছর মেয়াদি এসব উচ্চ ব্যয়ের কেন্দ্রে সরকারের গচ্চা গেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ কেন্দ্রগুলো নিয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। আজ থাকছে এ নিয়ে ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব
২০১৮ সালের মে মাসে উৎপাদন শুরু করে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে স্থাপিত বাংলা ট্র্যাক (প্রথম ইউনিট) ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার হলে এ কেন্দ্রে পাঁচ বছরে উৎপাদন করা যেত ৫৮০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। যদিও নির্ধারিত মেয়াদে এ কেন্দ্রটির সক্ষমতার মাত্র ৯ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে উৎপাদন করা হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি ২২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ।
বছরের বেশিরভাগ সময় বসে থাকলেও এ কেন্দ্রের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) পুরো ক্যাপাসিটি চার্জই পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে বাংলা ট্র্যাক (প্রথম ইউনিট) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে এক হাজার ৮৫৩ কোটি ২২ লাখ টাকা।
প্রায় একই অবস্থা যশোরের নওয়াপাড়ায় অবস্থিত বাংলা ট্র্যাক ১০০ মেগাওয়াট (দ্বিতীয় ইউনিট) সক্ষমতার কেন্দ্রটিতেও। দক্ষিণাঞ্চলের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার ১৮ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পাঁচ বছরে উৎপাদন করা হয়েছে ৫৪ কোটি ৬২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। যদিও এর সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করলে উৎপাদন করা যেত ২৯০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এ কেন্দ্রের জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৯৪৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
বাংলা ট্র্যাকের শুধু এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই নয়, ২০১৮ সালে অনুমোদন দেয়া ডিজেলচালিত ছয়টি কেন্দ্রের চিত্র একই। এগুলোর কোনোটিতেই সক্ষমতার ২০ শতাংশও ব্যবহার করা হয়নি। তবে বসিয়ে রেখে পিডিবিকে ঠিকই বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। এতে কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও পড়ত অস্বাভাবিক। আর সরকারের অর্থের প্রচুর অপচয় হতো এসব কেন্দ্রে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলা ট্র্যাক (প্রথম ইউনিট) ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৮ সালের মে মাসে উৎপাদন শুরু করে। ওই অর্থবছর দুই মাসে সক্ষমতার ১৫ শতাংশ ব্যবহার হয়। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর সক্ষমতার ব্যবহার হয় তিন শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছর এক শতাংশেরও কম, ২০২০-২১ অর্থবছর দুই শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছর ৯ শতাংশ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর ১৭ শতাংশ।
বাংলা ট্র্যাক (দ্বিতীয় ইউনিট) ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও ২০১৮ সালের মে মাসে উৎপাদন শুরু করে। ওই অর্থবছর দুই মাসে সক্ষমতার ২৬ শতাংশ ব্যবহার হয়। পরের বছরগুলোর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার ব্যবহার হয় ১৩ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৯ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছর ১৪ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছর ১২ শতাংশ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর ১৩ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি চলেছে। তবুও সক্ষমতার মাত্র ১৮ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে এ কেন্দ্রের।
পিডিবির তথ্যমতে, ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের ওরাহাটিতে নির্মিত এগ্রিকো এনার্জি সল্যুশন লিমিটেড ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সক্ষমতার ১৪ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পাঁচ বছরে উৎপাদন করা হয়েছে ৩৯ কোটি ৪৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। যদিও কেন্দ্রটির সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করলে উৎপাদন করা যেত ২৯০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। নামমাত্র ব্যবহার করলেও পাঁচ বছর বসিয়ে রেখে এ কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৯৪৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
এগ্রিকো এনার্জি সল্যুশন লিমিটেড ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৮ সালের জুন মাসে উৎপাদন শুরু করে। ওই অর্থবছর এক মাসে সক্ষমতার ২৫ শতাংশ ব্যবহার হয়। পরের বছরগুলোর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার ব্যবহার হয় পাঁচ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছর এক শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছর চার শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছর ১৫ শতাংশ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর ১৯ শতাংশ।
ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের ব্রাহ্মণগাঁওয়ে নির্মিত এগ্রিকোর আরেক কেন্দ্র পাওয়ার সল্যুশন লিমিটেড নির্মাণ করা হয়েছিল। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সক্ষমতার ১২ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পাঁচ বছরে উৎপাদন করা হয়েছে ৩৪ কোটি ৩৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। যদিও কেন্দ্রটির সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করলে উৎপাদন করা যেত ২৯০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ।
নামমাত্র ব্যবহার করলেও পাঁচ বছর বসিয়ে রেখে এ কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৯৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এগ্রিকো পাওয়ার সল্যুশন লিমিটেড ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও ২০১৮ সালের জুন মাসে উৎপাদন শুরু করে। ওই অর্থবছর এক মাসে সক্ষমতার ২১ শতাংশ ব্যবহার হয়। তবে পরের বছরগুলোর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার ব্যবহার হয় তিন শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছর এক শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছর তিন শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছর ১৪ শতাংশ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর ১৭ শতাংশ।
এদিকে ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে নির্মিত হয়েছিল ডিজেলচালিত সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এপিআর এনার্জি। ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রের মাত্র ৯ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পাঁচ বছরে উৎপাদন করা হয়েছে ৯২ কোটি ৩৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। যদিও কেন্দ্রটির সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করলে উৎপাদন করা যেত ৮৭০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। নামমাত্র ব্যবহার করলেও পাঁচ বছর বসিয়ে রেখে এ কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা।
এপিআর এনার্জি ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও ২০১৮ সালের জুন মাসে উৎপাদন শুরু করে। ওই অর্থবছর এক মাসে সক্ষমতার ১২ শতাংশ ব্যবহার হয়। তবে পরের বছরগুলোয় এ হার অনেক কমে যায়। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার ব্যবহার হয় তিন শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছর এক শতাংশেরও কম, ২০২০-২১ অর্থবছর তিন শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছর ১০ শতাংশ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর ১৮ শতাংশ।
অন্যদিকে ডিজেলচালিত ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যবহার হয়েছে প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে স্থাপিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২০০ মেগাওয়াট। তবে এর মাত্র চার শতাংশ ব্যবহার হয়েছে নির্ধারিত মেয়াদে। এতে পাঁচ বছরে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা হয়েছে মাত্র ৩১ কোটি ৩৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। যদিও কেন্দ্রটির সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করলে উৎপাদন করা যেত ৫৮০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। নামমাত্র ব্যবহার করলেও পাঁচ বছর বসিয়ে রেখে এ কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে সর্বোচ্চ এক হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।
মূলত প্যারামাউন্ট গ্রুপ এককভাবে লাইসেন্স নিলেও তারা কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যর্থ হয়। এতে বাংলা ট্র্যাককে যুক্ত করে ২০১৮-১৯ অর্থবছর উৎপাদন শুরু করে। ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ওই অর্থবছর মাত্র এক শতাংশ ব্যবহার করা হয়। পরের বছরগুলোয় এ হার অনেক কমই ছিল। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছর এক শতাংশেরও কম এবং ২০২০-২১ অর্থবছর এক শতাংশ ব্যবহার হয়। তবে ২০২১-২২ অর্থবছর সক্ষমতা ছয় শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছর আট শতাংশ ও বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছর এক শতাংশ ব্যবহার হয়েছে।
সব মিলিয়ে পাঁচ বছর তথা ৬০ মাস করে চলে ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে এ পাঁচ বছর সবগুলো কেন্দ্র মিলিয়ে সক্ষমতার মাত্র ১১ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে পুরো সক্ষমতার জন্যই। এতে পিডিবির গচ্চা গেছে ৯ হাজার ৪০৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। জানতে চাইলে পিডিবির তৎকালীন সচিব আহমদ কায়কাউসের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। পিডিবির ওই সময়ের চেয়ারম্যান ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ২০১৭ সালে সেচ মৌসুম ও রোজা একই সময়ে পড়েছিল। এতে হঠাৎ বিদ্যুতের সংকট তৈরি হয়।
সে সংকটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দায়মুক্তি আইনের আওতায় তড়িঘড়ি করে এ ছয় ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল।তারা আরও জানান, এ বিষয়ে পিডিবির কোনো মতামতই নেয়া হয়নি। তৎকালীন সচিবের উদ্যোগে এ লাইসেন্সগুলো দেয়া হয়েছিল। অথচ এগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এগুলোর ব্যবহারের হার দেখে। এছাড়া ডিজেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। প্রতি ইউনিটে ৩৫-৪০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়, যেখানে ফার্নেস অয়েলে প্রতি ইউনিটে ব্যয় হয় ১৫-১৮ টাকা। তাই খুব জরুরি না হলে এসব কেন্দ্র বসিয়েই রাখা হতো। যদিও এ কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ গচ্চা গেছে।
bsec dse