Home Banking আপাতত মার্জারে যাচ্ছে ১০ ব্যাংক

আপাতত মার্জারে যাচ্ছে ১০ ব্যাংক

by fstcap

আর্থিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে অনেক ব্যাংক। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, এমন সমালোচনা রয়েছে বিশ্লেষকদের মাঝে। সব মিলিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলো পুরো খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি প্রভাব ফেলছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। তাই দুর্বল ব্যাংককে সবলের সঙ্গে একীভূত করার (মার্জ) উদ্যোগ নেওয়া হয়। 

ব্যাংক কমানোর এমন উদ্যোগের উদ্দেশ্য ভালো হলেও পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নেওয়া অন্য সব পদক্ষেপের মতো এটিও শুরু হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর প্রক্রিয়াটি আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেবে ব্যাংকিং কমিশন। শিগগিরই গঠিত হতে যাচ্ছে বহুল কাঙ্ক্ষিত এই কমিশন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকিং কমিশন গঠিত হওয়ার পর সব ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক চিত্র পর্যালোচনার জন্য বিশেষ অডিট পরিচালিত হবে। এরপর ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা ও সম্পদের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত হবে কোন কোন ব্যাংক বন্ধ করা দরকার। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর মধ্যে যেগুলোর সঙ্গে অন্য ব্যাংক একীভূত করার উপযোগী সেসব ব্যাংককে আলাদা শ্রেণিভুক্ত করা হবে। এরপর দেখা হবে কোন ব্যাংকের সঙ্গে কোনটি একীভূত করলে দ্রুততম সময়ে সুফল আসবে। ব্যাংক মালিকদের পারস্পরিক পছন্দে এবং বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ায় একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো চাপ প্রয়োগ করা হবে না বা জোর করে কোনো ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হবে না।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তোয়াক্কা না করেই ব্যাংক একীভূতকরণে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াই লেজেগোবরে অবস্থায় পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজের জারি করা নীতিমালাও লঙ্ঘন করেছে। এমনকি কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে অনেকটা জোরজবরদস্তির মাধ্যমে ব্যাংক একীভূতকরণের চেষ্টা চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তথ্য বলছে, সর্বমোট আটটি ব্যাংক একীভূতকরার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনো প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অঘোষিত চাপে চলতি বছরের ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। একই ধারাবাহিকতায় গত ৩ এপ্রিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও বিডিবিএল ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের নাম ঘোষণা করা হয়। আর ৮ এপ্রিল সিটি ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক এবং ৯ এপ্রিল ইউসিবি এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের একীভূতকরণের ঘোষণা করা হয়। এ ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের স্বাস্থ্য যাচাই ছাড়াই একীভূতকরণের বিষয়টি জানানো হয়, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সরাসরি লঙ্ঘন। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নীতিমালায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যাংকের স্বাস্থ্য যাচাই করে ২০২৫ সালের মার্চের পর থেকে ব্যাংকগুলো নিজেদের আগ্রহের মাধ্যমে একীভূত হতে পারবে। এ ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতিমালা লঙ্ঘন করে তড়িঘড়ির আশ্রয় নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, সরকারি সিদ্ধান্তের পাশাপাশি মালিকপক্ষের সম্মতি থাকায় এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সচল রয়েছে। এ ছাড়া বাকি আট ব্যাংকের মধ্যে একীভূতকরণের সব কার্যক্রম থমকে গেছে। কয়েকটি ব্যাংক একীভূত হবে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংক। বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার খবরে ব্যাংকটিতে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। বিপুল অঙ্কের আমানত উত্তোলন করে নেন গ্রাহকরা। আর প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকরা আবেদন করেন আমানত উত্তোলনের জন্য। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের সহায়তা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠায় ব্যাংকটির পর্ষদ। এর আগে গত ১৬ এপ্রিল ‘বেসিক ব্যাংক সরকারি নয়’ বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র দাবি করেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাগজপত্রে বেসিক ব্যাংক সরকারি। এরপর রাজপথে আন্দোলন করেন বেসিক, রাকাব, বিডিবিএলসহ একীভূত ঘোষিত কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় কিছুটা এগিয়ে থাকা এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের বিষয়ে জানতে চাইলে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফিরোজ হোসাইন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের অডিট সম্পন্ন হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে কবে কখন দুই ব্যাংক মার্জ হবে।’

অন্য ব্যাংকগুলোরও একই অবস্থা। কর্মকর্তারা বলছেন, একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি কার্যত কাগজে-কলমে আছে। বাস্ততে এটি নিয়ে কোনো কার্যক্রম চলমান নেই। এ প্রসঙ্গে বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান গাজী বলেন, ‘একীভূতকরণ এমওইউ পর্যায়েই রয়েছে। অডিটর এসে ঘুরে গেছেন। এর বেশি অগ্রগতি নেই।’

একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি এবং এর গ্রহণযোগ্যতা ও ফলাফল বিষয়ে প্রতক্রিয়া জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘একটি দুর্বল ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই নিজ উদ্যোগে একীভূত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি, আবার এ প্রক্রিয়ায় নাম আসা সবল ব্যাংকগুলো স্বীয় উদ্যোগে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে এতে যুক্ত হতে সম্মত হয়েছে, সেটিও ঘটেনি। প্রক্রিয়াটি শুরু থেকেই স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।’

গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পরামর্শ দেয়। এরপর গত ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর অন্যান্য ব্যাংকের একীভূতের ঘোষণা আসে। গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একীভূত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই একীভূতকরণের ঘোষণা দেওয়াটা ভুল ছিল। এমন তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের কারণেই প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়ার আগেই ভেস্তে গেছে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে পরিকল্পনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যেসব ব্যাংকের মালিকানায় সমস্যা আছে সেগুলোতে নতুন পর্ষদ দেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই ব্যাংকিং কমিশন গঠিত হবে। তারা ব্যাংকগুলোতে অডিট করবে। এরপর ব্যাংকগুলোকে মার্জ করতে হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

 

দুর্বল ব্যাংকের চিকিৎসা হবে সোজা পথে

জানা গেছে, অব্যবস্থাপনা দূর করার মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ভাগ্য নির্ধারণে মনোযোগী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেনতেনভাবে টিকিয়ে রাখার নীতি থেকে সরে এসে সঠিক রোগ নির্ণয়ের পর চিকিৎসা শুরু করা হবে। প্রথমে লুটপাট বন্ধ, এরপর সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সমস্যা চিহ্নিত করা হবে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার নীতিতে প্রয়োজনে বন্ধ কিংবা মার্জ করা হবে। কোনো অনৈতিক সহায়তা দেওয়া হবে না। আমানতকারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ভুল জায়গায় টাকা ঢালার প্রবণতা বন্ধ করতেও মনোযোগ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিটি ব্যাংকের সমস্যা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করার কৌশলে হাঁটছেন নতুন গভর্নর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টেনে তোলার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বড় অঙ্কের লেনদেন বন্ধ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বড় বিনিয়োগে। এক কথায় ব্যাংকের তারল্য সংকট দূর করতে উভয় দিক থেকে অর্থ বেরিয়ে যাওয়া ঠেকানো হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসবে। তবে আমানতকারীদের সাময়িক অসুবিধায় পড়তে হবে এবং ব্যাংকগুলোর লাভের পরিমাণ কমে আসবে। তবে যেসব অর্থ খেলাপি হয়ে আছে তা আদায় করতে পারলে সংকট দ্রুতই কেটে যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্তনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে সেটি নিরসনের জন্য কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। নতুন করে লুটপাট বন্ধের পদক্ষেপ আশাবাদী হওয়ার পরিবেশ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে সাধারণ আমানতকারীদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের আমানত রাখার জন্য সচেতনতা জরুরি। সরকার কারও আমানতের দায় নেবে না, কিন্তু অব্যবস্থাপনা এবং লুটপাট বন্ধে পদক্ষেপ নেবে। সার্বিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টেনে তুলতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, সেসব বিষয়ে একটা ভালো শুরু হয়েছে বলা যায়। সামনে আরও ভালো কিছু হবে এমনটাই প্রত্যাশা করতে পারি।’

You may also like