ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানা সংশ্লিষ্ট বেক্সিমকো গ্রুপের তালিকাভুক্ত সব কোম্পানি পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসই।
এজন্য বিশেষ পরিদর্শন টিম পাঠাবে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসই (ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ) কর্তৃপক্ষ।
বাজার পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে একটি দল এ পরিদর্শন কার্যক্রম করবে জানিয়ে ডিএসই চেয়ারম্যান হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু বলেন, কোম্পানিগুলোর ‘অপারেশনাল’ কার্যক্রম কীভাবে চলছে, তা দেখে আসার পর সেটির ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে সুপারিশ প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘কোম্পানির অবস্থা দেখে ডিএসইর আইনে যা করার সুযোগ আছে আমরা তা করব।’’
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় ডিএসইর এমন পদক্ষেপের খবর জানা গেল; যখন পুঁজিবাজারে বেক্সিমকো গ্রুপের দুটি কোম্পানির শেয়ার ও একটি বন্ডের দাম ক্রমাগত কমছে। আর বেক্সিমকোর (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড) দাম ফ্লোর প্রাইসে থাকায় সেটির দাম কমার সুযোগ নেই। ক্রেতা না থাকায় এটির কেনাবেচাও নেই।
তবে তালিকাভুক্ত আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারদর ওঠানামার মধ্যে রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান রহমান।
মুনাফায় থাকা ও চালু থাকার পরও কোম্পানি পরিদর্শন করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে ডিএসইর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলেন, মামলার আসামী হওয়ায় সালমান রহমানের অনুপস্থিতি বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলো পরিচালনায় কোনো ধরনের পরিবর্তন, বাধার সম্মুখীন হচ্ছে কি না, তা দেখবে পরিদর্শনে যাওয়া দল। একইসঙ্গে কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেটিও আসবে পরিদর্শন দলের প্রতিবেদনে। এসব বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কাজে দেবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন অগাস্টের শুরুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপ পাওয়ার পর সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ৫ অগাস্ট আন্দোলনকারীদের ঢাকামুখী লং মার্চের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
দেশজুড়ে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জ্বালাও পোড়াও, ভাঙচুর ও লুট হওয়ার খবর আসতে থাকে। সরকার পতনের দিনেই তার গুলশানের বাসা ভাঙচুর ও লুট করা হয়। তার মালিকানাধীন কারখানাগুলোতে হামলার চেষ্টা চলে। ঢাকায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিসের জানালার কাচ ও ভবনের ফটক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
সরকার পতনের পর নৈরাজ্যের ওই সময়ে সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ আগেই দেশ ছেড়েছেন বলেও খবর আসে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান রহমানও নিরুদ্দেশ ছিলেন।
এর কয়েকদিন পরে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে একই বিমানে দেশ ছাড়েন সালমান। তবে গত ১৩ অগাস্ট নৌপথে দেশ ছেড়ে পালানোর সময়ে বেক্সিমকো গ্রুপের এই ভাইস চেয়ারম্যানকে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ রাজধানীর সদরঘাট থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তাদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ১৬ জুলাই ঢাকা কলেজের সামনে হকার শাহজাহানকে (২৪) হত্যায় নিউ মার্কেট থানার মামলায় ‘ইন্ধনদাতা’ হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন সালমান ও আনিসুলকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।
তার গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের পর থেকে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামে প্রভাব পড়তে শুরু করে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব শেয়ারের বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার ধরে রাখা বা নতুন করে বিনিয়োগ করা নিয়ে দ্বিধা-সংশয়ের মধ্যে রয়েছেন।
বেক্সিমকো গ্রুপের তিন কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুর এখন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। বেক্সিমকো সিনথেটিকস ও বেক্সটেক্স নামে বছর কয়েক আগে আরও দুটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত ছিল। এরমধ্যে বেক্সিমকো সিনথেটিক তালিকাচ্যুত (ডিলিস্টিং) হয়েছে এবং বেক্সটেক্স বেক্সিমকো লিমিটেডের সঙ্গে একীভূত হয়েছে।
দেশের পুঁজিবাজার ডিএসই’র পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জেও তালিকাভুক্ত আছে ওষুধ খাতের কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।
লন্ডন স্টকে ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা
নিজের ভাই আহমেদ সোহাইল ফাসিহুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সালমান ফজলুর রহমান (সালমান এফ রহমান) ১৯৭০ সালে গঠন করেন বেক্সিমকো (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড), যা পরে গ্রুপ হিসেবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে বিভিন্ন খাতে।
ওষুধ, বস্ত্র, আমদানি-রপ্তানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হোটেল, প্রকৌশল, মিডিয়াসহ নানা খাতে ছড়িয়ে আছে সালমানের বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যবসা। পুঁজিবাজারেও তার প্রভাব নিয়েও নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।
কাগজে কলমে গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক হলেও তার নেতৃত্বেই এসব কোম্পানি পরিচালিত হয়েছে। তার ভাই ও উদ্যোক্তা সহযোগী আহমেদ সোহাইল ফাসিহুর রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ও কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যানের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালকও।
সালমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে কোম্পানিটির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এতে কোম্পানির ওপর কেমন প্রভাব পড়বে।
রোববার কোম্পানির পক্ষ থেকে ‘স্টেটমেন্ট অন পলিটিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস সিচুয়েশন’ শীর্ষক মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা পিএসআই দিয়ে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জকে বেক্সিমকো ফার্মার পক্ষ থেকে বলা হয়, সালমান রহমান কোম্পানির দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত নন।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করার মত কোনো ক্ষতিসাধন হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাধাগ্রস্ত হওয়ার মানে হচ্ছে, কর্মীদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ বিবেচনায় সরবরাহ চ্যানেল একটু হ্রাস করা হয়েছিল, এখন যা সাধারণ পর্যায়ে চলে আসছে।
‘‘অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দেশের বিদ্যমান উত্তেজনাকর পরিবেশ স্বাভাবিক করা। আমরা আশা করছি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সরবরাহ ব্যবস্থা সাধারণ পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব। আমরা আশ্বস্ত করছি, এখন পর্যন্ত চলমান পরিস্থিতি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে না। পরবর্তী হালনাগাদ তথ্য যথা সময়ে বিনিয়োগকারিদের জানানো হবে।’’
লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোনো কোম্পানির পরিচালক পর্ষদ সদস্যে পরিবর্তন বা মামলাজনিত তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তবে দেশের বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও এ ধরনের কোনো তথ্য ডিএসইতে জানায়নি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।
এমন প্রশ্নে কোম্পানির পক্ষে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিনিধি থাকা বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সিনিয়র ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের নিয়ম অনুযায়ী কোম্পানির পরিচালকদের মধ্যে পরিবর্তন বা মামলাজনিত কোনো বিষয় দেখা দিলে বিনিয়োগকারীদের জানাতে হয়।
‘‘আমরা তাই জানিয়েছি, সালমান এফ রহমান কোম্পানি ও গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান। তিনি দৈনন্দিন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। পরিচালক হিসেবে কোম্পানির পর্ষদে যোগ দেন।’’
দেশের স্টক এক্সচেঞ্জে সে ধরনের কোনো নির্দেশনা না থাকায় জানানো হয়নি বলেও দাবি রফিকুলের।
দরপতনে বেক্সিমকোর কোম্পানি
সরকার পতনের পর সালমান রহমান আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় দর কমতে শুরু করে বেক্সিমকো ফার্মার।
ডিএসইতে গত ৪ অগাস্ট ১০৫ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হওয়া বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ার সবশেষ রোববার হাতবদল হয় ৮২ টাকা ৯০ পয়সায়। এই কয়দিনে দর হারায় ২২ টাকা ৩০ পয়সা বা ২১ দশমিক ১৯ শতাংশ।
অন্যদিকে লন্ডন স্টকএক্সচেঞ্জে সবশেষ শেয়ারটি এক দিনে ৩৫ দশমিক ৪৪ পাউন্ড থেকে কমে লেনদেন হয় ৩৩ দশমিক ৭৫ পাউন্ডে।
দরপতন থামছে না তালিকাভুক্ত শাইনপুকুর সিরামিকস ও বেক্সিমকো সুকুক বন্ডে। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, শাইনপুকুর সিরামিকস গত ৮ অগাস্ট থেকে শেয়ার দর ৩২ টাকা ২০ পয়সা থেকে ক্রমাগত নামছে।
সবশেষ রোববার লেনদেন হয়েছে ২৪ টাকা ২০ পয়সায়। গত ছয় কার্যদিবসে শেয়ার দর পতন হয় ৮ টাকা ২৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
একইভাবে শেয়ার দর কমেছে বেক্সিমকো সুকুক বন্ডেরও। একই সময়ে ইউনিট দর ৭৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে কমে সবশেষ লেনদেন হয় ৫৭ টাকা ৫০ পয়সায়।
ছয় দিনে প্রতি ইউনিটের দর কমেছে ১৭ টাকা বা ২২ দশমিক ৮১ শতাংশ। আরেক কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার দর ধরে রাখতে পেরেছে ফ্লোর প্রাইসের কারণে।
আর শেয়ার দর ১১ টাকা ১০ পয়সা থেকে নেমে ১০ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার দরেও, যার চেয়ারম্যান পদে রয়েছে সালমান রহমান।
তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই শেষে ব্যাংকটিতে তার শেয়ার সংখ্যা হচ্ছে তিন কোটি ৮৪ লাখ ৫২ হাজার ৫৫৪টি, যা মোট শেয়ারের ২ শতাংশ।