২০২২ ও ২০২৩ সালে দেশের পুঁজিবাজারের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক।
২০২২ ও ২০২৩ সালে দেশের পুঁজিবাজারের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। চলতি বছরে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে এমন প্রত্যাশা ছিল বিনিয়োগকারীদের। বছরের শুরুর দিকে বাজারে কিছুটা চাঙ্গা ভাবও দেখা গিয়েছিল। যদিও সেটি ফিকে হতে বেশি সময় লাগেনি। গত আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর পুঁজিবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা করেছিলেন বিনিয়োগকারীরা, যার প্রভাবে কয়েক দিন সূচক ও লেনদেনে ঊর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছিল। তবে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ঘুরেফিরে আবারো পতনের বৃত্তে আটকা পড়েছে পুঁজিবাজার। ফলে আবারো হতাশাজনক আরেকটি বছর পার করেছেন দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা। তিন বছর ধরেই টানা নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে। এ সময়ে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ২৩ শতাংশ পয়েন্ট হারিয়েছে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালের শুরুতে ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ২৪৬ পয়েন্টে। এ বছরের শেষ কার্যদিবসে সূচকটি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২১৬ পয়েন্টে। এক বছরে সূচকটি কমেছে ১ হাজার ৩০ পয়েন্ট বা ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সময়ে বাজার মূলধন ১৫ দশমিক ১ শতাংশ কমে ৬ লাখ ৬২ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালে ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৫৭৮ কোটি টাকা। এ বছর দৈনিক গড় লেনদেন দাঁড়িয়েছে ৬৬৩ কোটি টাকায়। এ সময়ে লেনদেন বেড়েছে ৯ শতাংশ। দেশের আরেক পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এ বছর প্রায় ২২ শতাংশ পয়েন্ট হারিয়েছে। এ সময়ে এক্সচেঞ্জটির দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
চলতি বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে পুঁজিবাজারে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। পাশাপাশি নির্বাচনের পরে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে এমন আশাবাদও ছিল। নির্বাচনের কিছুদিন পরই দেড় বছর পর ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়ে যায় এবং এতে বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। এরপর বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও সেটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এ বছরের জুনে বাজেট ঘোষণা পর্যন্ত নিম্নমুখিতা বজায় ছিল। বাজেটে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের ঘোষণা আসার পর পুঁজিবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতিও প্রভাব ফেলেছে পুঁজিবাজারে। বাজেটের পর আবারো বিনিয়োগকারীদের মধ্য শেয়ার কেনার প্রবণতা বাড়ার কারণে সূচকে ঊধ্বমুখিতা দেখা গিয়েছিল। তবে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের প্রভাবে পুঁজিবাজারেও দরপতন ঘটে। আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজার নিয়ে বড় ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয় এবং এ সময়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের পরিমাণও বেড়ে যায়। যদিও বাজারের এ ঊর্ধ্বমুখিতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের দুর্দশার চিত্র সামনে আসার পর সেটির প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে।
পুঁজিবাজারে খাতভিত্তিক শেয়ারের রিটার্ন পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালে একমাত্র টেলিযোগাযোগ খাতে ৫ শতাংশ ইতিবাচক রিটার্ন এসেছে। এর বাইরে বাকি সব খাতই নেতিবাচক রিটার্নে ছিল। ২০২৪ সালে শেয়ারদর বাড়ার ক্ষেত্রে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল বেশি। পুঁজিবাজার পরিস্থিতির হতাশাজনক চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রেও। এ বছর পুঁজিবাজারে মাত্র সাতটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। চলতি বছর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারেও নেতিবাচক রিটার্ন এসেছে। তালিকাভুক্ত ১৩টি বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে তিনটির শেয়ারে ইতিবাচক রিটার্ন এসেছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামনের বছরেও পুঁজিবাজারকে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে সেটি সামনের বছরেও অব্যাহত থাকবে। সামনের বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে টানাপড়েন বজায় থাকবে। তবে রেমিট্যান্স ও রফতানি বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া, বিদেশী ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির আওতায় সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয় তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব পুঁজিবাজারেও দেখা যাবে। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন কবে হবে সেটি সামনের বছরের দ্বিতীয়ার্ধেই স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং এর ফলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও কমে আসবে। বৈশ্বিক তহবিল ব্যবস্থাপক এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটালের (এএফসি) প্রক্ষেপণ বলছে, ২০২৫ সালে দেশের পুঁজিবাজারের সূচক ৫ হাজার থেকে ৫ হাজার ৮০০ পয়েন্টের মধ্যে ওঠানামা করতে পারে। এ সময় দৈনিক গড়ে ৫০০-৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হবে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২৪ সাল দেশের পুঁজিবাজারের জন্য একটি হতাশাজনক বছর ছিল। লেনদেনের পরিমাণ কমতে কমতে এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে ৯৫ শতাংশ বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান বর্তমানে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। গত ১৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজারের পুঞ্জীভূত রিটার্ন হিসাব করলে দেখা যায় এটি ঋণাত্মক অবস্থায় আছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনো দেশের পুঁজিবাজার ঋণাত্মক অবস্থানে থাকার নজির নেই। পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত ভালো শেয়ার নেই। এক্ষেত্রে নতুন করে বাজারে ভালো শেয়ারের জোগান দেয়া হলে সেটি বাজারকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হতো। ভালো শেয়ার না থাকার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জাঙ্ক শেয়ারে বিনিয়োগের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এটি পুঁজিবাজারের জন্য ক্ষতিকর। এ ধরনের প্রবণতা দূর করতে কঠোর বাজার নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিক থেকে সুনির্দিষ্ট রোডমাপ থাকা প্রয়োজন। এটি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। https://bonikbarta.com
sharemarket