ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন হয়েছে প্রায় ১০ বছর আগে। ফাঁকি দেয়া টাকা পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠান, গিয়েছে উচ্চ আদালতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১০ বছর পর আদালত বললেন, সুদসহ ফাঁকি দেয়া সেই ভ্যাট পরিশোধ করতে। ৩০ দিনের মধ্যে ফাঁকি দেয়া টাকা পরিশোধ করতে ভ্যাট বিভাগকে বলেছেন আদালত। নির্দেশনা পেয়েই ভ্যাট কমিশনারেট শুনানি শেষে বিচারাদেশ দিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ১০ বছর পরও ভ্যাট বিভাগের চিঠিতে সাড়াই দিচ্ছে না। ভ্যাট ফাঁকি দেয়া প্রতিষ্ঠান হলো ফু-ওয়াং বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। যে মামলায় বিচারাদেশ হয়েছে, তাতে ফাঁকির পরিমাণ সুদসহ প্রায় এক কোটি ৫১ লাখ টাকা। তবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সুদসহ ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি ২৮ লাখ টাকা। এই সুদ আরোপের বিষয়ে শুনানিতে অংশ নিতেও কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা) ২০১৩ সালে ফু-ওয়াং বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নিরীক্ষা করে। এতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়। পরে ওই বছরের ১৪ জুলাই ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেটকে একটি প্রতিবেদন দেয় ভ্যাট গোয়েন্দা। ওই প্রতিবেদন যাচাই শেষে ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেটের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দীপক কান্তি সেন ২১ জুলাই মূসক ফাঁকি ও অনিয়ম মামলা দায়ের করেন। এতে দেখা গেছে, ফু-ওয়াং বেভারেজ ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনটি খাতে সুদসহ এক কোটি ৯৫ লাখ ৮৪ হাজার ৩৭৯ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। তিনটি খাতের মধ্যে জোগানদার খাতে সুদসহ প্রায় ৭৭ লাখ টাকা, অবৈধ রেয়াত প্রায় এক কোটি টাকা ও সেবামূল্যের ওপর উৎসে ভ্যাট প্রায় ১৭ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে এনবিআরের এক আদেশ অনুযায়ী, জোগানদার খাতে উৎসে মূসক কর্তনের বিধান থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠান এই খাতে উৎসে মূসক কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এছাড়া পলি পাউস বা র্যাপারের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে অতিরিক্ত রেয়াত নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি একটি লিমিটেড কোম্পানি। ভ্যাট গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় হিসাব পুস্তক, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, চলতি হিসাব পুস্তক, দাখিলপত্র, মূল্যভিত্তি ঘোষণা, আমদানি তথ্য ও বার্ষিক প্রতিবেদন (সিএ রিপোর্ট) যাচাই করে এই ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে।
সূত্র আরও জানায়, ভ্যাট গোয়েন্দা ভ্যাট ফাঁকির যেকোনো প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য বা মতামত নেয়। ফু-ওয়াং বেভারেজের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে বক্তব্য বা মতামত দিতে প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট গোয়েন্দা থেকে পাঁচবার চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বারবার সময় বৃদ্ধির আবেদন করে আসছে। বাধ্য হয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠিয়ে দেয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেট ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই প্রতিষ্ঠানকে ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। শুনানি বা লিখিত জবাব না দিয়ে প্রতিষ্ঠান দুই মাস সময় বৃদ্ধির অনুরোধ জানায়। ওই দুই মাসের মধ্যে কোনো বক্তব্য বা লিখিত জবাব না দিয়েই ভ্যাট কমিশনারেটের কারণ দর্শানো নোটিশকে তর্কিত করে প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালতে রিট করে। আদালত ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানো নোটিশের কার্যকারিতার ওপর তিন মাস স্থগিতাদেশ দেন। ভ্যাট কমিশনারেটের পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হয়। পরে স্থগিতাদেশ বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর অর্থাৎ প্রায় ১০ বছর পর আদালত আদেশ দেন, যাতে ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত দাবিনামা অনুযায়ী মূসক ও ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদ আদায় করতে ভ্যাট কমিশনারেটকে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেট সূত্রমতে, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দাবিনামা চূড়ান্ত করতে লিখিত জবাব দাখিল ও শুনানিতে অংশ নিতে কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানকে ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সুদসহ ভ্যাট ফাঁকি এক কোটি ৯৫ লাখ ৮৪ হাজার ৩৭৯ টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা লিখিত বক্তব্য দাখিল করেননি বা শুনানিতে অংশ নেননি, উল্টো আদালতে রাজস্ব ও সুদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। তিনবার চিঠি দেয়া হলেও কোনো জবাব দেয়নি প্রতিষ্ঠান। পরিশেষে ভ্যাট কমিশনারেট আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিবেদন ও দলিলাদি পর্যালোচনা করে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি আদেশ দিয়েছে, যাতে ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৫১ লাখ ১৫ হাজার ৩৮২ টাকা। ফাঁকি দেয়া এই রাজস্ব আদেশ জারির ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। অথবা ৯০ দিনের মধ্যে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে বলা হয়েছে। তবে আদেশ জারির পরও প্রতিষ্ঠান কোনো রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে।
অপরদিকে ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেট থেকে ফু-ওয়াং বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ১৫ জানুয়ারি একটি দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে, যাতে ভ্যাট গোয়েন্দার দেয়া সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৫ লাখ ৫৫ হাজার আট টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে লিখিত জবাব ও শুনানিতে অংশ নিতে বলা হয়েছে। ফাঁকি দেয়া এই ভ্যাটের ওপর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই শতাংশ হারে সুদ দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ২৮ লাখ ৬৮ হাজার ৬৮৩ টাকা। তবে এই ভ্যাট ও সুদ প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেনি বলে সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠান একদিকে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। সেই ভ্যাট পরিশোধ না করে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। তবে আদালত আবার সেই ভ্যাট প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করতে বলেছেন। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ভ্যাট কমিশনারেট সব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ভ্যাট পরিশোধ তো দূরের কথা, আদালতের নির্দেশনাও মানছে না। আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট দিতেই হবে। আদালতের নির্দেশনা মেনে ভ্যাট কমিশনারেট ফাঁকি দেয়া ভ্যাট আদায়ে মূসক আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানাতে ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড ও ফু-ওয়াং বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. আজিজুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা একটার বিচারাদেশ পেয়েছি। সেখানে এক কোটি ৫১ লাখ টাকা দেখেছি। অন্য আরেকটার কোনো কাগজ পাইনি। কাগজ না দেখে কীভাবে মন্তব্য করব। কাগজ পেলে আমাদের যে ডিপার্টমেন্ট কাজ করে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করব।
source: sharebiz.net
fu wang beverage