বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বিদেশি বিনিয়োগ ১০ দেশনির্ভর। এসব দেশের মধ্যে বিনিয়োগের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, লুক্সেমবার্গ, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই, কানাডা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ডস, মরিশাস ও কুয়েত। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে এই ১০ দেশের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১২০ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ–সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে দুই ধরনের পোর্টফোলিও বা পত্রকোষ বিনিয়োগ করেন। তার একটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে, যা ইকুইটি সিকিউরিটিজ হিসেবে পরিচিত। অন্যটি ডেবট সিকিউরিটিজে। ইকুইটি সিকিউরিটিজ বলতে সেসব সিকিউরিটিজকে বোঝায়, যারা বছরের শেষে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়। তালিকাভুক্ত লভ্যাংশনির্ভর বিভিন্ন কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড ইকুইটি সিকিউরিটিজ হিসেবে বেশি পরিচিত। আর ডেবট সিকিউরিটিজ বলতে সেসব সিকিউরিটিজকে বোঝায়, যারা বিনিয়োগের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে সুদ দিয়ে থাকে। এ ধরনের সিকিউরিটিজের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বিল ও বন্ড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ইকুইটিতে বিদেশি বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ছিল ৮২ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৯ কোটি ডলার বা ৩২ শতাংশ কম। এই ৮২ কোটি ডলারের মধ্যে ৮০ কোটি ডলারই ছিল ১০ দেশের বিনিয়োগ। এসব দেশের মধ্যে বেশির ভাগেরই বিনিয়োগ কমেছে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের। দেশের শেয়ারবাজারে দেশটির বিনিয়োগ ২০২২–২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ২৬ কোটি ডলার বা ৪১ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৩৭ কোটি ডলারে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় এক কোটি ডলার, সিঙ্গাপুর থেকে দেড় কোটি ডলার, লুক্সেমবার্গ থেকে আট কোটি ডলার, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড থেকে সোয়া দুই কোটি ডলারের বিনিয়োগ কমেছে।
বিনিয়োগ বেড়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা ও কেম্যান আইল্যান্ডসের। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত অর্থবছরে শেয়ারবাজারে ইকুইটি বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ডলারে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল তিন কোটি ডলার। কানাডা থেকে শেয়ারবাজারে এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ প্রায় ১০ লাখ ডলার বেড়ে দাঁড়ায় সোয়া ৪ কোটি ডলারে। আর কেম্যান আইল্যান্ডস থেকে ৫০ ডলারের বিনিয়োগ বেড়ে গত অর্থবছরে দাঁড়ায় দেড় কোটি ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশিদের মোট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ছিল ১৭৩ কোটি ডলার বা ২০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯১ কোটি ডলার বা ১০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল ডেবট বা ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজে। আর ৮১ কোটি ডলার বা ৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল ইকুইটি সিকিউরিটিজ বা শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে। অর্থাৎ লভ্যাংশ–নির্ভর শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের চেয়ে গত অর্থবছরে ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেশি ছিল।
গত অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে যে ইকুইটি বিনিয়োগ করেছে, তার সিংহভাগ বিনিয়োগই ছিল ওষুধ ও রসায়ন খাতে। এ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে গত অর্থবছর শেষে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরে শেয়ারবাজারে মোট বিদেশি বিনিয়োগের প্রায় সাড়ে ৪২ শতাংশ। গত অর্থবছরে বিদেশিদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ছিল ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা ও মিউচুয়াল ফান্ড খাতে। এ খাতে গত অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ২৩ কোটি ডলার, যা ওই বছরে শেয়ারবাজারে মোট বিদেশি বিনিয়োগের ২৮ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ ছিল খাদ্য খাতের কোম্পানিগুলোতে। এ খাতে গত অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ১২ কোটি ডলার, যা ওই বছর শেয়ারবাজারে মোট বিদেশি বিনিয়োগের সাড়ে ১৪ শতাংশ। এর বাইরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অন্যান্য খাতের কোনোটিতেই বিদেশি বিনিয়োগ দুই অঙ্কের ঘর ছাড়ায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত তিন অর্থবছরের বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগের তথ্য তুলে ধরেছে প্রতিবেদনটিতে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২১–২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ছিল ২৯৫ কোটি ডলার বা ৩৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার। ২০২২–২৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২৩৩ কোটি ডলার বা ২৭ হাজার ৯৬০ কোটি টাকায়। সর্বশেষ গত অর্থবছরে তা আরও কমে নেমে এসেছে ১৭৩ কোটি ডলার বা ২০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকায়।
শেয়ারবাজারে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেয়ারবাজারে কয়েক বছর ধরে বিদেশি বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল শেয়ারের মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাজারের পতন ঠেকাতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বিগত শিবলী কমিশন কয়েক ধাপে এই ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। তাতে শেয়ারবাজারে ভালো মৌলভিত্তিসহ বেশির ভাগ শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে যায়। বন্ধ হয়ে যায় এসব শেয়ারের লেনদেন। ফলে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী ব্লক মার্কেটসহ বিভিন্ন পন্থায় যেভাবে পেরেছে শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়ে গেছেন।
শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে যখনই স্থানীয় মুদ্রার দরপতন হতে থাকে, তখন বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার টান লাগে। কারণ, তাতে দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তাঁরা। প্রথমত, বাজারে শেয়ারের দাম কমে গেলে তার জন্য মূলধনি লোকসান হয়। এরপর বিক্রির অর্থ বিদেশে নিয়েও যাওয়ার ক্ষেত্রে মুদ্রার দরপতনের কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। কারণ, তখন তাঁদের ডলার কিনতে খরচ বেশি পড়ে।
শেয়ারবাজারে বিদেশি ইকুইটি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মোহাম্মদ মুসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশ কিছু দিন ধরে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ ধরনের পরিবেশে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমবে, এটাই স্বাভাবিক। দেশের মানুষ যেখানে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না, সেখানে বিদেশিদের বিনিয়োগ বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া ডলারের দামের অস্থিরতাও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ।’
লুক্সেমবার্গ, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, কেম্যান আইল্যান্ডস, মরিশাস ও ইউএই থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘আমার ধারণা, এসব বিনিয়োগের বড় অংশই বাংলাদেশিদের। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ যখন কেউ দেশে ফিরিয়ে আনতে চান, তখন একটি অংশ শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হিসেবে ফেরত আনেন।’ prothomalo.com
sharebazar, biniyog