শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যান্য খাতের মতো দেশের পুঁজিবাজারেও সংস্কারের ছোঁয়া লেগেছে। এমনিতেই কোভিড-১৯ মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় গত কয়েক বছরে টালমাটাল পুরো বিশ্বের অর্থনীতি। যার আঘাত লেগেছে বাংলাদেশেও। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অবনমন, বিগত সরকারের দুর্নীতি এবং ব্যাংক খাতের টাকা লুটসহ নানা নেতিবাচক কর্মকা-ের প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারেও।
উপরন্তু অর্থ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট এবং দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধাক্কা পুঁজিবাজারকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে। এমন আশা-নিরাশার দোলাচলে শুরু হচ্ছে পুঁজিবাজারের নতুন বছর ২০২৫। বিদায়ী বছরে পুঁজি-বাজারে ধারাবাহিকভাবে সূচকের পতনের সঙ্গে কমেছে বাজার মূলধন। অর্থ হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাই বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে সূচক, মূলধন ও পুঁজি কমার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমেছে।
হাসিনার পতনের পর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় শেষের পাঁচ মাস রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি) কঠোর অবস্থান নিলেও তা কাজে আসেনি। ফলে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা না ফেরায় বছরজুড়েই ছিল বিনিয়োগকারীদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি।
গত ১৮ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম দায়িত্ব নেন। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১০ আগস্ট তিনি বাধ্য হয়ে বিএসইসি থেকে পদত্যাগ করেন। সেই হিসাবে তিনি ২০২৪ সালের বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে প্রায় সাড়ে ৭ মাস দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের গত ১৮ আগস্ট বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে দায়িত্ব দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। আর গত ১৯ আগস্ট তিনি বিএসইসিতে নতুন চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের প্রথমদিন ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ২৪২ পয়েন্টে। বছরব্যাপী দরপতনের ধারা অব্যাহত থাকায় বছরের শেষ কার্যদিবস সোমবার লেনদেন শেষে সেই ডিএসইএক্স ৫ হাজার ২১৬ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক এক হাজার পয়েন্টের বেশি কমেছে। বাজার মূলধনেও হয়েছে বড় পতন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো যদি বাজারবান্ধব হয় এবং সংস্কারগুলো যদি যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যায় তাহলে আমরা আশা করছি আগামী বছর শেয়ারবাজার ভালো হবে। বাজারবান্ধব নীতি সংস্কারের পাশাপাশি বাজারে ভালো আইপিও আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। ভালো কোম্পানির আইপিও আনা সম্ভব হলে বাজারের গভীরতা বাড়বে।’
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার দিন গত ১৯ আগস্ট ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫ হাজার ৭৭৫.৪৯ পয়েন্টে। শেষ দিন সোমবার লেনদেন শেষে সেই ডিএসইএক্স ৫ হাজার ২১৬ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে।
তবে ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক সর্বনিম্ন কমে দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৮৯৮.৫২ পয়েন্টে। এর আগের দিন সূচকটি ১৪৯.২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছিল ৪ হাজার ৯৬৫.৩৯ পয়েন্টে। যা গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছিল। এর আগে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ডিএসইর সূচক কমে দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৯৩৪ পয়েন্টে। আর ডিএসইএক্স সূচকটি গত ১১ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ বেড়েছিল ৬ হাজার ৪৪৭.০৭ পয়েন্টে।
২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসইর শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস সূচক ছিল ১ হাজার ৩৬১.২৩ পয়েন্টে। আর ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএস সূচক অবস্থান করছে ১ হাজার ১৬৭.৩৫ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস সূচক কমেছে ১৯৩.৮৮ পয়েন্ট বা ১৪.২৪ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসইর ডিএস৩০ সূচক ছিল ২ হাজার ৯১.৫৪ পয়েন্টে। আর ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএস৩০ সূচক কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৩৮.২৯ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএস৩০ সূচক কমেছে ১৫৩.২৫ পয়েন্ট বা ৭.৩২ শতাংশ।
২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮০ হাজার ৮২৩ কোটি ৪২ লাখ ২ হাজার টাকা। আর ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৯ হাজার ২০৫ কোটি ৫১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১ লাখ ২১ হাজার ৬১৭ কোটি ৯০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ১৫.৫৮ শতাংশ। তবে ২০২৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৯ কোটি ২৯ লাখ টাকায়, যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালের ২৮ মে ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বনি¤œ করে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫১ হাজার ২৮৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকায়।
বিনিয়োগকারী বলছেন, পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছরের মধ্যে ২০২৪ সালে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি পতন ঘটেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক চার বছরে মধ্যে সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত বছরের গত ২৮ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক কমে ৪ হাজার ৮৯৮.৫২ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে চার বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থানে নেমে আসে।
২০১০ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে বিনিয়োগকারী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, কোনো কোনো শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে টানা দরপতনের ফলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি ৭০ শতাংশ কমে গেছে।
গত ১৯ অক্টোবর বড় দরপতনের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজারে অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। এ সময়ে অসংখ্য দুর্বল ও অস্তিত্বহীন কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এসব কোম্পানি এখন বাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তি ও জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া সর্বনি¤œ মূল্যস্তর বা ফ্লোরপ্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের সীমা পরিবর্তনসহ নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে বাজারের প্রকৃত অবস্থা ঢেকে রাখা হয়েছিল। এখন কৃত্রিম চেষ্টা না থাকায় অনিয়ম, কারসাজির অনিবার্য পরিণতি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ অবস্থা থেকে বাজারের উন্নয়ন ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি, সুশাসন নিশ্চিতে বিএসইসি ও সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিএসইসি।
গত ১৯ আগস্ট বিএসইসিতে যোগদানের দিন বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ গণমাধ্যমকে জানান, পুঁজিবাজারের সুশাসন নিশ্চিত করা ও আস্থা ফেরানো তার প্রথম কাজ। প্ূঁজিবাজারকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। গত একদশকে পুঁজিবাজারে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। গত ৪ মাসে পুঁজিবাজারে সুশাসন অনতে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ১২টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৭২২ কোটি টাকার জরিমানা করেছে। যা বিএসইসির ইতিহাসে সর্বোচ্চ জরিমানার সিদ্ধান্ত।
পুঁজিবাজারে পুনর্গঠিত বিএসইসির অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি হলো- অনিয়ম-কারসাজি-দুর্নীতি অনুসন্ধানে সমন্বিত তদন্ত কমিটি গঠন করা। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে গত ১ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়। গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের টেরা রিসোর্সেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং কনসালট্যান্ট জিয়া ইউ আহমেদ, ফিনান্সিয়াল সেক্টর স্পেশালিস্ট ইয়াওয়ার সাইদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মো. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মো. জিশান হায়দার ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম। গঠিত সমন্বিত তদন্ত কমিটি পুঁজিবাজারের বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি হলো- পুঁজিবাজার সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ৭ অক্টোবর একটি বিশেষ পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর সিনিয়র পার্টনার এ এফ এম নেসার উদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা আকবর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন।
২০২৪ সালের পুনর্গঠিত বিএসইসির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যানসহ সকল স্বতন্ত্র পরিচালকদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা। ডিএসই ও সিএসইর কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে পৃথক দুটি পরিদর্শন কমিটি গঠন। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ১১ ব্যক্তির বেনিফিসিয়াল ওনার্স অ্যাকাউন্ট (বিও অ্যাকাউন্ট) জব্দ করা। মাল্টি সিকিউরিটিজের সকল সুবিধায় নিষেধাজ্ঞা।
একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে ৩ ব্যক্তির লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা। বিএসইসির দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম’ এর শুভেচ্ছা দূত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নিয়োগ বাতিল। শেয়ারের দাম কমার সর্বনি¤œ সীমা (ফ্লোর প্রাইস) প্রত্যাহার। জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সঙ্গে বিএসইসির সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব বাতিল। শেয়ার দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে পুরনো সার্কিট ব্রেকার পুনর্বহাল করা হয়।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ ২০ জনের বিও হিসাব জব্দ।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন। একই সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ তার পরিবার অন্যান্য সদস্য ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের স্ত্রী, মেয়ের স্বামী, আত্মীয়সহ তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখা হবে। অ্যাসেট ম্যানেজার প্রতিষ্ঠান স্ট্রাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন।
ব্রোকারেজ হাউস সিনহা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইওদের ব্যাংক ও বিও হিসাব জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে তালিকাভুক্ত সিডব্লিউটি প্রাইভেট ইক্যুইটি লিমিটেডের পরিচালিত চার ফান্ডের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ। মার্চেন্ট ব্যাংক এসএফআইএল ফাইন্যান্স পিএলসির (পূর্বের নাম স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড) অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন।
লেনদেন নিষ্পত্তির সময়সীমা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। এ জন্য ডিএসই ও সিএসইতে সমন্বিত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিএসইসির সার্ভিল্যান্স সিস্টেম আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। জনগণকে বিনিয়োগ শিক্ষা দিতে গ্রামীণফোন ও বিএসইসি একসঙ্গে কাজ করবে। ২৮টি কোম্পানিকে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগারি থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
পুঁজিবাজারের ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ৬ সদষ্যের কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৯টি কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বা পুনঃপ্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আরপিও) মাধ্যমে সংগ্রহ করা অর্থ কোথায় ও কিভাবে বিনিয়োগ করেছে তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত। পুঁজিবাজারের স্বার্থে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্তির লক্ষ্যে দেশের অন্যতম বৃহৎ মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও পিএইচপি গ্রুপের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিএসইসি আলোচনা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বিক্রির মূলধনী মুনাফার ওপর কর কমানোর সুপারিশ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ার লেনদেন থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি অর্জিত মূলধনী মুনাফার ওপর করের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে করহার ছিল ৩০ শতাংশ। এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের ব্যবহার এবং বিগত ৬ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন।
কাট্টলি টেক্সটাইলের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে সংগ্রহীত তহবিল ‘নয়ছয়’ করার অভিযোগ বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ। সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৯১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ১১৭টি বিও অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার নির্দেশ।
আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বিদেশী বিও ॥ দেশের পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছর ধরে ধরাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারছে না পুঁজিবাজার। ফলে পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ অনেকটাই কমে এসেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব খোলার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ৪.৯৪ শতাংশ কমেছে।
ফলে পুঁজিবাজারের পতনমুখী প্রবণতা ও বিভিন্ন কারণে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিও হিসাবের সংখ্যা ৫.২৭ শতাংশ কমেছে। একইসঙ্গে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা কমেছে ৫.০২ শতাংশ। নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব খোলার পরিমাণ কমেছে ৬.০৩ শতাংশ। এ ছাড়া স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবে সংখ্যা কমেছে ৪.৯৪ শতাংশ এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবে সংখ্যা কমেছে ১৫.৪৪ শতাংশ।
পুঁজিবাজারের তথ্য ভা-ার হিসেবে পরিচিত সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২৪ সালের ১ জানুয়ারি বিনিয়োগকারীদের মোট বিও হিসাবে সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪০টি। আর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের মোট বিও হিসাবে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৮৮০টি। সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগকারীদের মোট বিও হিসাবে সংখ্যা কমেছে ৯২ হাজার ৫৬০টি বা ৫.২৭ শতাংশ।
বাজার থেকে ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা উত্তোলন ॥ ২০২৪ সালের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ৪টি এবং কোয়ালিফায়েড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে ২টি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া ২টি ব্যাংক বন্ড ছেড়ে মূলধন সংগ্রহ করেছে। সেই হিসবে ২০২৪ সালে পুঁজিবাজার থেকে মোট ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছে। এর আগের বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালের পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে ৩টি, কিউআইও মাধ্যমে ৩টি, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে ১টি ও ৪টি বন্ড ইস্যু করে মোট ১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছিল।
সেই হিসেবে গত বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে ৪৬৭ কোটি টাকা কম মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) গত এক বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানির আইপিও, কিউআইও ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আর এ বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উল্লেখযোগ্য কোনো কোম্পানির আইপিও বা কিউআইওতে আসেনি।
ডিএসই ও সিএসইর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালে পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করা কোম্পানিগুলোর মধ্যেÑ এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড ১০০ কোটি টাকা, বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড লিমিটেড ৩৫০ কোটি টাকা, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড ৯৫ কোটি টাকা এবং টেকনো ড্রাগস লিমিটেড ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। পুঁজিবাজার থেকে কিউআইওর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করা কোম্পানিগুলোর মধ্যে- ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সেসরিজ লিমিটেড ৫ কোটি টাকা এবং ওয়েব কোটস পিএলসি ৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংক ফাস্ট পারপেচুয়াল বন্ড ৪৫০ কোটি এবং ইউসিবি সেকেন্ড পারপেচুয়াল বন্ড ২৭০ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে পুঁজিবাজারে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেমিনি সি ফুডের ১২৮ কোটি টাকার রাইট শেয়ারের আবেদন বাতিল করেছে বিএসইসি। কোম্পানিটি ২ (আর):১ হারে রাইট শেয়ার ইস্যু করতে চেয়েছিল। অর্থাৎ বিদ্যমান প্রতি ১টি শেয়ারের বিপরীতে ২টি রাইট শেয়ার ইস্যু করতে চেয়েছিল। প্রতিটি রাইট শেয়ারের অফার মূল্য ছিল ফেসভ্যালু ১০ টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত ৫০ টাকা প্রিমিয়ামসহ মোট ৬০ টাকা। কোম্পানিটি ২ কোটি ১৩ লাখ রাইট শেয়ার ছাড়তে চেয়েছিল। dailyjanakantha.com
sharemarket