একদিকে তারল্য সংকট মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা ধার, অন্যদিকে রেকর্ড মুনাফা!
দেশের ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট মেটাতে গত বছরজুড়ে লাখ লাখ কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বছরের শুরুতে তথা ফেব্রুয়ারিতে এ ধারের পরিমাণ ছিল ৮৪ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। যদিও বছর শেষে ডিসেম্বরে তা ৩ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। রেপো, বিশেষ রেপো ও অ্যাশিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসেবে স্বল্পমেয়াদি এ ধার দেয়া হয়। দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এত পরিমাণ ধার দেয়ার নজির নেই।
দেশের ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট মেটাতে গত বছরজুড়ে লাখ লাখ কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বছরের শুরুতে তথা ফেব্রুয়ারিতে এ ধারের পরিমাণ ছিল ৮৪ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
আবার তারল্যের ক্ষেত্রে দেউলিয়াত্বের বছরেই রেকর্ড নিট মুনাফা দেখায় দেশের ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশের ব্যাংকগুলো ১৪ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখিয়েছে। এত পরিমাণ নিট মুনাফাও দেশের ব্যাংক খাতে অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এ নিট মুনাফার অর্থের বড় অংশই আবার ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ হিসেবে বণ্টন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেউলিয়াত্বের হাত থেকে বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যাংককে বাছবিচার ছাড়াই অর্থ ধার দিয়েছে। আবার কিছু ভালো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোয় ধার নিয়ে উচ্চ সুদের ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনেছে। এ কারণে একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারের পরিমাণ বেড়েছে, আবার ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে সরকারকে ঋণ দিয়ে ভালো মুনাফা পেয়েছে। কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে নিট মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোরও অভিযোগ আছে। সঠিকভাবে নিরীক্ষা করা হলে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংককেই লোকসানি হিসেবে গণ্য করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
দৈনন্দিন লেনদেনের প্রয়োজনে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার (কলমানি) থেকে অর্থ ধার করতে পারে। কলমানি বাজারে পর্যাপ্ত ধার না মিললে রেপোতেও অন্য ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার সুযোগ আছে। বাজার থেকে কোনো মাধ্যমে টাকা ধার না পেলে এর পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে রেপো, বিশেষ রেপো ও এএলএস হিসেবে ১ থেকে ২৮ দিন মেয়াদি ধার নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার প্রবণতা বাড়তে শুরু করে। গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার দেয়ার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৭১ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে এ ধারের পরিমাণ কিছুটা কমে ৮৪ হাজার ৪০৩ কোটি টাকায় নেমে আসে। কিন্তু নভেম্বরে গিয়ে এক মাসেই ধারের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা ছাড়ায়। এরপর ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার দেয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩২ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার দেয়া অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় তিন গুণেরও বেশিতে।
সাধারণত রেপো, বিশেষ রেপো ও এএলএস হিসেবে দেয়া দৈনন্দিন ধার যোগ করা হয় না। কারণ একদিন মেয়াদি রেপো পরের দিনই ফেরত আসে। তবে দেশের ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার প্রবণতা দেখাতে ২০২৩ সালের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে এ-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে রেকর্ড ১৯ লাখ ২২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা দেয়া হয় রেপো হিসেবে। আর বিশেষ রেপো হিসেবে দেয়া হয় আরো ৪০ হাজার ২৫ কোটি টাকা। অ্যাশিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট বা এএলএস হিসেবে ৯ লাখ ৩১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ধার দেয়া হয়। গত বছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো বা নীতি সুদহার ছিল ৬ শতাংশ। ডিসেম্বর নাগাদ এ সুদহার পৌনে ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছিল।
ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার প্রবণতা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুর্বল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কিছু ব্যাংকে তারল্যের তীব্র সংকট ছিল। এ ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে দৈনন্দিন লেনদেন মিটিয়েছে। আবার অতিরিক্ত তারল্য থাকা ব্যাংকগুলোও উচ্চ সুদে সরকারকে ঋণ দিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। কারণ রেপো রেটের তুলনায় ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বেশি ছিল। ভালো ব্যাংকগুলো নিজেদের সংগৃহীত আমানত দিয়ে বিল-বন্ড কিনেছে। আর সে বন্ড জামানত রেখে কম সুদের রেপো ধার করেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ধারের টার্নওভারও বেড়ে গিয়েছে।’
এ ব্যাংক নির্বাহীর বক্তব্যের সত্যতা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর রেপোর সুদহার ছিল ৬-৭ শতাংশ। আর একই সময়ে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের গড় সুদহার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়া অর্থ সরকারকে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো বড় অংকের অর্থ আয় করেছে। ২০২৩ সালে সুদবহির্ভূত খাত তথা বিনিয়োগ, কমিশন ও ফি বাবদ ব্যাংকগুলোর আয় ছিল ৪৮ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। যেখানে বিতরণকৃত ঋণের সুদ বাবদ নিট ৩৩ হাজার ৯০ কোটি টাকা আয় করতে পেরেছিল ব্যাংকগুলো।
চলতি বছরের শুরুতে এসে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আরো তীব্র হয়। এ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার প্রবণতা আরো বেড়ে যায়। আবার একই সময়ে সরকারের ট্রেজারি বিলের সুদহারও প্রায় ১২ শতাংশে উন্নীত হয়। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল নিলামের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ৭ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এসব বিলের সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৩৭ থেকে ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। যদিও এ মুহূর্তে দেশের রেপো রেট ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিট ১ লাখ ১৯ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাত থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ৮২ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। ব্যাংক খাত ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হারালে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়েও গত দুই অর্থবছর সরকারকে ঋণ দিয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে আরো ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে গত জুন শেষে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ৯ লাখ ২ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
গত দেড় দশকের সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির ভারে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন বিপর্যস্ত। গত বছরের শুরুতে বিধ্বস্ত ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নির্দেশনায় অন্তত পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করে দেয়ার ঘোষণাও দেয়া হয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিপর্যয়কর সে বছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ নিট মুনাফা করেছে দেশের ব্যাংক খাত। ২০২৩ সালে ব্যাংকগুলো নিট মুনাফা করেছে ১৪ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালেও ১৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখিয়েছিল ব্যাংকগুলো। যদিও ২০২১ সালে ৫ হাজার ২০ কোটি ও ২০২০ সালে ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখিয়েছিল দেশের ব্যাংক খাত। ২০২০ সালের আগেও নিট মুনাফার এ পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকার আশপাশে সীমাবদ্ধ ছিল।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সীমাহীন তারল্য ও ডলার সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দার এ সময়ে ব্যাংকের উচ্চ মুনাফা অর্জনকে মিরাকল বা অলৌকিক ঘটনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে সীমাহীন লুণ্ঠন হয়েছে। ঋণের নামে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের হয়ে গিয়েছে। আবার এলসি খোলার নামে দেশ থেকে সে অর্থ পাচারও হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষ্ক্রিয়তা ও কিছু ক্ষেত্রে সহায়তার কারণে সেসব অপরাধ ঠেকানো সম্ভব হয়নি। আবার ব্যাংকের নিরীক্ষায় অনিয়মগুলো চিহ্নিতও করা হয়নি। এ কারণে ব্যাংক খাতের বিপর্যয় সত্ত্বেও মুনাফা বেড়েছে।’
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর একটি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ব্যাংকটি দুই বছর ধরেই নগদ টাকার সংকটে রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘আমরা গ্রাহকদের আতঙ্ক দূর করার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে সফলও হয়েছি। এখন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের চাপ অনেকটাই কমেছে। ইসলামী ব্যাংকের আমানত প্রবাহ দ্রুতই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে তারল্য সংকটে পড়া সাধারণ ধারার ব্যাংকগুলোর পাশে দাঁড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক উপকরণ রয়েছে। কিন্তু ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর পাশে দাঁড়ানোর তেমন কোনো উপকরণ নেই। আমরা কেবল সুকুক জমা রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা বেশকিছু প্রডাক্ট চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি।’ বণিক বার্তা
bangladesh bank bb banking system