অর্থনীতির ‘হৃৎপিণ্ড’ হিসেবে পরিচিত দেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। অন্তত তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয়ও হট্টগোল হচ্ছে। গভর্নরসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেও শৃঙ্খলা ফেরেনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অভিভাবকশূন্য হয়ে যাওয়ার কারণেই ব্যাংক খাতে এতটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ (ইউসিবি) বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে গতকাল বিশৃঙ্খলা হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে দাপ্তরিক কাজ করতে দেয়া হয়নি। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দুজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিপক্ষের পিটুনিতে ব্যাংকটির মাসুদ মিয়া নামের একজন কর্মকর্তা গুরুতর আহতও হয়েছেন। আর বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সামনে। ন্যাশনাল ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকসহ আরো কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন কিংবা নতুন পরিচালক অন্তর্ভুক্তির দাবি উঠেছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা এমনিতেই নাজুক। ঋণের নামে অর্থ লোপাটের কারণে বেশির ভাগ ব্যাংকের ভিত একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে। এখন সময় হলো ব্যাংক খাতকে টেনে তোলার। কিন্তু যে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে, সেটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। আতঙ্কিত গ্রাহক আমানতের টাকা তুলে নিতে শুরু করলে দেশের অনেক ব্যাংকই দেউলিয়া হয়ে যাবে। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি নতুন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করছেন, এখন সময় হলো যুদ্ধবিরতির। এখন মারামারির সময় নয়। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতি আর জনগণের অর্থ লুণ্ঠনের অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় কিংবা যে ভাষায় প্রতিবাদ করা হচ্ছে, সেটি ঠিক নয়। যাদের অভিযোগ আছে, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিতভাবে জানাবেন। গভর্নর নিয়োগের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চয়ই অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতো সজ্জন ও অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে স্থান পেয়েছেন। তার প্রথম দায়িত্ব হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অচলাবস্থা দূর করা। দ্রুত ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল করে আনা।’
শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর থেকেই বিশৃঙ্খলা চলছে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিতে। গত কয়েক বছরে ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত ও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা মঙ্গলবার থেকে বিক্ষোভ করে আসছেন। ওইদিনই কর্মকর্তারা শীর্ষ স্থানীয় বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে ব্যাংকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। ডিএমডি আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিন, কাজী মো. রেজাউল করিমসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নামফলক ভেঙে ব্যাংকের বাইরে ফেলে দেয়া হয়। কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ার ভয়ে এসব কর্মকর্তা ব্যাংকে আসছেন না। বুধবার ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলীকে অবরুদ্ধ করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। আর গতকাল ব্যাংকটির এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে দাপ্তরিক কাজ করতে দেয়া হয়নি। সকালে ব্যাংকে গেলেও কর্মকর্তাদের প্রতিবাদের মুখে তিনি বাসায় ফিরে যান।
বিক্ষোভে যোগ দেয়া কর্মকর্তাদের দাবি হলো, ২০১৬ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের সৎ ও দক্ষ অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বিপরীতে দ্রুত পদোন্নতি পেয়েছেন ব্যাংকের অর্থ লোপাটের সহযোগীরা। এখন সেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ব্যাংকে আর চাকরি করতে দেয়া হবে না। আবার ২০১৬ সাল থেকে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদেরও আর ব্যাংকে ঢুকতে দেয়া হবে না।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় শীর্ষ কর্মকর্তাদের হেনস্তা করা হচ্ছে, সেটি ঠিক হচ্ছে না। অন্যায় কিংবা দুর্নীতির বিচার করার জন্য বহু সময় পাওয়া যাবে। কর্মকর্তাদের অবশ্যই ধৈর্য ধরা দরকার। বিশৃঙ্খলার কারণে ইসলামী ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিই ধসে পড়বে।’
পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের দাবি জানাতে গতকাল সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও সাবেক পরিচালকদের কয়েকজন বিক্ষোভ করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হকের নেতৃত্বে সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, রাব্বান আলীসহ কয়েকজন শেয়ারধারী ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে যান। এ সময় ব্যাংকটির বেশকিছু কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে যোগ দেন। পরে ব্যাংকটির বর্তমান মালিকপক্ষের কিছু লোকের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়। রেজাউল হকসহ শেয়ারহোল্ডারদের কয়েকজন ব্যাংকটির ডিএমডি আব্দুল হান্নান খান ও মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। তবে এ সময় ব্যাংকটির এমডি জাফর আলম অফিসে ছিলেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনী ব্যবহার করে আমাদের ব্যাংকের পর্ষদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। এরপর ব্যাংকটিতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট চালানো হয়েছে। আমরা এখন ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধার করে ভালো অবস্থানে নিতে চাই। গতকাল আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ায় একজন কর্মকর্তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। তার শরীরে অন্তত ৩০টি সেলাই দিতে হয়েছে। ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন করতে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
এদিকে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে (ইউসিবি) সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন ব্যাংকটির দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। গতকাল সকালে গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুনে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন।
দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে ইউসিবির যাত্রা ১৯৮৩ সালে। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। তবে শুরু থেকেই পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এমএ হাসেম ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই পরিবারের একাধিক সদস্য বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকটির পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। উদ্যোক্তা হিসেবে অনেকে যুক্ত থাকলেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল এ দুই পরিবারের হাতে। তবে ২০১৭ সালে এমএ হাসেমসহ তার সন্তানদের ব্যাংকটির পর্ষদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন আখতারুজ্জামানের ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান। তবে রুকমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার ভাইয়েরা পরিচালনা করতেন বলে কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন।
গতকাল ব্যাংকটির কিছু শেয়ারহোল্ডারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি আবেদন জমা দেয়া হয়। ওই আবেদনে বলা হয়, ‘রুকমিলা জামান ব্যাংকের চেয়ারপারসন হলেও সাইফুজ্জামান চৌধুরী কার্যত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং তার স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের কারণে ব্যাংকটি আজ দেউলিয়া হওয়ার পথে। যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে, যা মূলত এ ব্যাংকের আমানতকারীদের লুটের অর্থ।’
২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ‘অবাধ লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার’ করা হয়েছে বলেও আবেদনে অভিযোগ করা হয়।
বিক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ কাদরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শেয়ারধারী হিসেবে পরিচয় দেয়া কিছু ব্যক্তি ব্যাংকের সামনে এসে জড়ো হয়েছিলেন। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা দাবি করেছেন, ইউসিবির পর্ষদ পুনর্গঠন করতে হবে। আমি বলেছি, আপনাদের অভিযোগ পর্ষদে উপস্থাপন করা হবে। ওই সময় সেনাবাহিনীর একটি টহল দল সেখানে এসে উপস্থিত হয়। এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।’
source: https://bonikbarta.net/home/news_description/394339/বড়-ধরনের-বিশৃঙ্খলার-মুখে-ব্যাংক-খাত-