বৈশ্বিক ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে ১৮ জুলাই থেকে টানা পাঁচদিন পুরোপুরি সংযোগহীন ছিল বাংলাদেশ। এতে ভেঙে পড়ে প্রযুক্তিগত যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে প্রথমে বেশকিছু এলাকায় ইন্টারনেটের গতি ধীর করা হয়। পরে একপর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দেশ। বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় এ নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করা হয় বলে বৈশ্বিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ক্লাউড ফ্লেয়ারের বৈশ্বিক ইন্টারনেট আউটেজ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্যে উঠে এসেছে।
একইভাবে ইন্টারনেট ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল সিরিয়া, মৌরিতানিয়া ও ফিলিস্তিনেও। এর মধ্যে সিরিয়ায় ইন্টারনেট আউটেজ ছিল মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা। মঙ্গলবার রাত থেকে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড সেবা চালু হলেও মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে। একইভাবে সরকারি নির্দেশে ২ জুলাই থেকে মৌরিতানিয়ায় ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
দেশের তিন মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমএনও) ও নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আর্থ টেলিকমিউনিকেশনের বরাত দিয়ে ক্লাউড ফ্লেয়ার জানিয়েছে, ১৮ জুলাই বেলা ২টা ৪৫ মিনিট থেকে নেটওয়ার্ক আউটেজ শুরু হয় বাংলাদেশে। এর মধ্যে গ্রামীণফোন লিমিটেডের নেটওয়ার্ক ১৭ জুলাই রাত ৭টা ২০ মিনিট থেকে, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনের নেটওয়ার্ক সোয়া ৮টা থেকে এবং রবি আজিয়াটা লিমিটেডের নেটওয়ার্ক ১৮ জুলাই রাত সাড়ে ১২টা থেকে আউটেজের আওতায় পড়ে। আর্থ টেলিকমিউনিকেশনের নেটওয়ার্ক ১৮ জুলাই দুপুর ১২টার পর থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে।
ক্লাউড ফ্লেয়ারের তথ্যে সিরিয়া, মৌরিতানিয়া ও ফিলিস্তিনে গত সপ্তাহে ইন্টারনেট আউটেজের বিষয়ও উঠে আসে। এর মধ্যে সিরিয়ায় বৃহস্পতিবার সরকারের নির্দেশনায় নেটওয়ার্ক আউটেজ হয়। তবে তা ওইদিন বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত বজায় ছিল। মৌরিতানিয়ায় ২ জুলাই থেকে ইন্টারনেট আউটেজ চলছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে ইন্টারনেট আউটেজ বজায় রয়েছে গত অক্টোবর থেকে। দেশটির বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক রাজনীতিতে ইন্টারনেট বিষয়টাকে এখন মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে পাঁচদিনের ইন্টারনেট আউটেজের অর্থ হলো এ সময়টায় সারা দেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক প্রযুক্তিবিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেট আউটেজ সেভাবে কখনো হয়নি। এর আগে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেটে ধীরগতি করে দেয়া হতো। তবে তাও বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। এবার টানা পাঁচদিনের জন্য ইন্টারনেট ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এতে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ ছিল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের ৫-১০ বছর সময় লেগে যাবে।’
বিশ্বের খুব কম দেশেই ইন্টারনেট আউটেজ হয় উল্লেখ করে ওই প্রযুক্তিবিদ আরো বলেন, ‘পৃথিবীর খুব বেশি দেশে ইন্টারনেট আউটেজ হয় না। এ ধরনের ঘটনা ঘটে সাধারণত ভারতের মণিপুর ও কাশ্মীর অঞ্চলে। ইসরায়েলের নির্দেশনায় ইরাক কিংবা ফিলিস্তিনে মাঝে মাঝে ইন্টারনেট আউটেজের ঘটনা ঘটে। তবে তা খুব বেশি স্থায়ী হয় না। কখনো ২ ঘণ্টা, কখনোবা ৫ ঘণ্টার মতো। বাংলাদেশে তা পাঁচদিন ছাড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগে ধীরগতি, মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হয়নি। এ ধরনের পরিস্থিতি একটি দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির জন্য ইতিবাচক নয়।’
আর্থিকভাবে আপাতত এ কয়েক দিনের ক্ষতির হিসাব করা গেলেও দীর্ঘস্থায়ী যে ক্ষতি হতে যাচ্ছে সেটির প্রভাব মারাত্মক বলে মনে করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। কারণ বিদেশী ক্লায়েন্টরা চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পেলে অর্ডার বাতিল করে দেবে। একই সঙ্গে নেতিবাচক রিভিউ আসবে। এতে পরবর্তী সময়ে নতুন ক্লায়েন্টের কাজ পেতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা ফ্রিল্যান্সারের বেশ বেগ পেতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইন্টারনেট আউটেজ একেকটি দেশের ওপর একেকভাবে প্রভাব ফেলে। সবচেয়ে বেশি তুলনা করা হয় আউটেজ হওয়া দেশটি বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে কতটুকু ও কীভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। ইন্টারনেট আউটেজ আমাদের প্রতিটি খাতে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগের মতো বিষয়গুলো জড়িত। এমনিতেই আমরা বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছি না। এখন ইন্টারনেট আউটেজের ফলে এ অবিশ্বাস আরো বেশি করে চেপে বসেছে।’
ইন্টারনেট আউটেজ মূলত দুইভাবে হয়। একটি সরকারের নির্দেশনায় বন্ধ করা এবং অন্যটি হলো কোনো ধরনের ত্রুটির কারণে বন্ধ হওয়া। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন অধ্যাপক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি দোষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু সরকারের নির্দেশনায় যদি ইন্টারনেট বন্ধ করা হয় তাহলে এর বিষয় ভিন্ন। এ ধরনের ঘটনায় বড় প্লেয়ারদের (যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়ার মতো ক্ষমতাধর দেশ) অবস্থান কী, তারা এ নিয়ে কী ভাবছেন তার ওপর চাপের বিষয়টি নির্ভর করে।’
আরব বসন্তের সময় ২০১১ সালে ইন্টারনেট আউটেজের ঘটনা ঘটায় মিসরের কর্তৃপক্ষ। পরে বহির্বিশ্ব থেকে বিষয়টি নিয়ে তীব্র নিন্দা জানানো হলে কিছুক্ষণের মধ্যে দেশটির কর্তৃপক্ষ তা খুলে দিতে বাধ্য হয়। বিষয়টি তুলে ধরে ওই অধ্যাপক আরো বলেন, ‘আমাদের ক্ষেত্রে লক্ষ করেছি, আমাদের মিত্র হিসেবে বিবেচিত ভারতের গণমাধ্যমগুলো এ ঘটনা নিয়ে কথা বলেছে এবং তা মারাত্মকভাবে বলেছে। সেখানকার অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনও শিক্ষার্থীদের পক্ষে সংহতি জানিয়েছে। তারা কেন এমনটি করল, এটিকে বিবেচনায় নেয়া উচিত।’
source: https://bonikbarta.net/home/news_description/392665
bangladesh internet situation