সর্বোচ্চ সীমা তুলে নেয়ার পর দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমাগত বাড়ছে। গত চার মাসের ব্যবধানে সর্বোচ্চ সুদহার ৯ থেকে বেড়ে ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। গবেষণা বলছে, বিদ্যমান ধারায় বাড়তে থাকলে আগামী দুই-তিন বছর পর তা ১৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে ‘ইন্টারেস্ট রেট ফোরকাস্ট; এ কম্পারেটিভ অ্যানালাইসিস’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ পূর্বাভাস দিয়েছে সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল।
বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক ‘দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেডের’ সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল। সুদহারের পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) ও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের রেকর্ড ঘাটতি, আমদানি ব্যয়, রফতানি ও রেমিট্যান্স আয়, টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন, ডলারের বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা, ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি, তারল্য পরিস্থিতিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে। সামগ্রিক পর্যালোচনা শেষে বলা হয়, আগামী দিনগুলোয় দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বিপরীতে আরো কমে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যাংক ঋণের সুদহারে। ক্রমাগতভাবে সুদহার বেড়ে দুই-তিন বছর পর ১৩-১৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সুদহার সংক্রান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে দেশের ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এরপর ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়। একই সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। এর প্রভাবে ২০২০ সালে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার নেমে আসে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশে। এর পরের বছর আরো কমে ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশে নামে। ২০২২ সালেও গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে ঋণের সুদহার বাড়তে থাকে। জুন থেকে সর্বোচ্চ সীমা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিপরীতে সুদহার নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমাগত বেড়েছে। চলতি নভেম্বরে সর্বোচ্চ সুদহার ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশে উন্নীত হয়। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালে তা বেড়ে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ হবে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, তারল্য সংকট অব্যাহত থাকলে দুই-তিন বছর পর ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৫-১৬ শতাংশ হতে পারে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি বছরের মধ্যেই ব্যাংক ঋণের সুদহার ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। কারণ সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার ক্রমাগত বাড়ছে। এর মধ্যেই তা ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহ ব্যয়ও (আমানতের সুদহার) অনেক বেড়ে গেছে।’
সুদহার বাড়লে দেশের বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ঋণের সুদহার ১৮-২০ শতাংশ থাকার সময় দেশের বেসরকারি খাত সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সুদহার অর্ধেকে নেমে আসার পর বেসরকারি খাত সমৃদ্ধ না হয়ে উল্টো দুর্বল হয়েছে। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। আমি মনে করি, যেকোনো ব্যবসার জন্য “ইফিশিয়েন্সি” খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষতা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যেকোনো ব্যবসায় সমৃদ্ধি আনতে পারে।’
ব্যাংক ঋণের সুদহার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও দেখা যাচ্ছে। গতকাল দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের (কলমানি) সুদহার ১০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এর মধ্যে একদিন মেয়াদি ধারের সুদহার উঠেছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে। উচ্চ এ সুদহারে চাহিদা সত্ত্বেও অনেক ব্যাংক তারল্য ধার করতে পারেনি। ফলে ব্যাংকগুলো তারল্যের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে।
চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত ৪ অক্টোবর নীতি সুদহার বা রেপো রেট এক ধাক্কায় দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে রেপো রেট ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহার ৮ দশমিক ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে নীতি সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার ৪ দশমিক ৫০ থেকে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে। নীতি সুদহারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো টাকা ধার নেয়। সুদহার বাড়ানোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি সুদে অর্থ ধার করতে হচ্ছে।
অর্থের সরবরাহ কমানোর কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করলেও এরই মধ্যে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। সুদহার বেশি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ধার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ৪ অক্টোবর নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্তের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দৈনিক ধারের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ হাজার কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকগুলোর নেয়া ধারের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। গত ২৫ অক্টোবর দেশের ইতিহাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ২৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা ধার নেয় ব্যাংকগুলো। এরপর প্রতিদিন নেয়া ধারের পরিমাণ ১৪-২০ হাজার কোটি টাকায় ওঠানামা করছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা ধার করেছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি সপ্তাহে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার উঠেছে ১০ শতাংশে। আর ১৮২ দিন মেয়াদি বিলের সুদহার ১০ দশমিক ২০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার উঠেছে ১১ শতাংশে।
ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা নিচ্ছে সরকার। দাতা সংস্থাটির ঋণ দেয়ার শর্ত অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, যা স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে পরিচিত। প্রতি মাসের শুরুতে এ স্মার্ট রেট জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত জুলাইয়ে স্মার্ট রেট ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। এর পর থেকে এ হার বাড়তির দিকে রয়েছে। চলতি নভেম্বরের জন্য স্মার্ট রেট ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর সঙ্গে অতিরিক্ত সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ যুক্ত করে নভেম্বরে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে দেশের ব্যাংক খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি বেশ শ্লথ। অনেক ব্যাংকের আমানত না বেড়ে উল্টো কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড একটি। দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি এ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মেহমুদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মুদ্রাবাজারে তারল্যে সংকট এখন প্রকট। আমরা চেষ্টা করেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আমানত সংগ্রহ করতে পারছি না। দেশের কিছু ব্যাংক এখন মেয়াদি আমানতের জন্য ১২-১৩ শতাংশ সুদও প্রস্তাব করছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেড়ে যাবে, এটিই স্বাভাবিক।’
সুদহার বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করলেও দেশের অর্থনীতির অতীত ভিন্ন তথ্যই দিচ্ছে। বণিক বার্তার পক্ষ থেকে দেশের গত ৪০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বাড়া-কমার সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদহারের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন নব্বইয়ের দশকে ব্যাংকগুলোয় বাণিজ্যিক ঋণের সুদহার ছিল ১৮-২০ শতাংশ। ওই সময় দেশে গড় মূল্যস্ফীতিও ছিল দুই অংকের ঘরে। আবার ২০২০ সালে যখন ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দেয়া হয়, তখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ দুই দশক আগে ব্যাংক ঋণ অনেক দামি হওয়া সত্ত্বে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি।
চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশের মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে সব ধরনের পণ্য বিক্রি কমে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
source: bonikbarta.com