নিরাপদ বিনিয়োগের খাত সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ। প্রতি মাসেই বিক্রির চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। টানা আট মাস ধরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগের (বিক্রি) পরিমাণ ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। সবমিলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এ খাতে নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ১০ মাসে মোট বিক্রির চেয়ে এই পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বেশি ভাঙানো হয়েছে। এর মানে আলোচ্য সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণই পায়নি সরকার। আগামীতেও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আর এ কারণেই নতুন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অনেকটাই কমানো হয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে।
নিম্ন মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা (সুদ) দেয় সরকার। সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্য ও সেবার দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে মানুষের, যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়ের উপর। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ে যাদের সংসার চলে, তাদের অনেকেই এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদপূর্তির আগেও অনেকে সঞ্চয়পত্র ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ মেয়াদপূর্তিতেও পুনর্বিনিয়োগ না করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। আবার যাদের কাছে টাকা আছে, তারাও এখন কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ এখন ব্যাংকে টাকা রাখলেও বেশি সুদ মিলছে। গত মাসে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পর অনেক ব্যাংকই সঞ্চয়পত্রের কাছাকাছি বা এর চেয়ে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ধস অব্যাহত রয়েছে।
প্রতি অর্থবছরের বাজেটে নিট বিক্রি হিসেবে সঞ্চয়পত্রের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, যা সরকারের ঋণ হিসেবে গণ্য হয়। চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। তবে বিক্রি ধারাবাহিক কমতে থাকায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরে ৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ গত এপ্রিলে
সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে ২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। তার আগের মাস মার্চে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের এপ্রিল মাসে নিট বিক্রি ইতিবাচক ছিল প্রায় ৫৮২ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল ৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। এই হিসাবে এবার নিট বিক্রি ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ ৪ গুণের বেশি বেড়েছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৫ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ইতিবাচক ছিল। তবে এরপর থেকে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হতে থাকে। সেপ্টেম্বরে ঋণাত্মক হয় ১৪৭ কোটি, অক্টোবরে এক হাজার ৪০ কোটি, নভেম্বরে এক হাজার ৫৫৪ কোটি, ডিসেম্বরে ২ হাজার ২০৪ কোটি, জানুয়ারিতে ১ হাজার ২৮৭ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৫৪১ কোটি এবং মার্চে ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা এবং এপ্রিলে হয় ২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেষ আট মাসে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন একশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা এবং আইএমএফের পরামর্শে সব ধরনের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকে আমানত সংগ্রহেও আকর্ষণীয় সুদ দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। বিশেষ করে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো আমানতে প্রায় ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ অফার করছে, যা সঞ্চয়পত্রের চেয়েও বেশি। বর্তমানে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এছাড়া পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সুদ ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তবে মেয়াদপূর্তির আগে ভাঙলে এই সুদও মিলছে না। ফলে গুরুত্ব হারাচ্ছে সঞ্চয়পত্র।
জানা যায়, সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে এনআইডি ও টিআইএন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা শুরু হয়। ফলে যারা আগে সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, তাদের অনেকেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে নতুন করে আর এতে বিনিয়োগ করেননি। আবার বর্তমানে ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ওপর অর্জিত সুদের বিপরীতে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। এ ছাড়া বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের নানা স্তর চালু করা হয়েছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ যে কমবে, তা সরকার আগেই আন্দাজ করেছিল। সে জন্য চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে। ফলে নতুন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে মাত্র ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার নিটঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এই লক্ষ্যমাত্রা কমানোর পেছনে অন্যতম কারণ হলো- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত পূরণ। সংস্থাটির ঋণ প্রস্তাবে বিভিন্ন শর্তের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের ঋণ কমানোর শর্তও রয়েছে।
বাড়ছে ব্যাংকঋণ নির্ভরতা : সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস অব্যাহত থাকায় সরকারের ব্যাংকঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে একই সময়ে আগের নেওয়া ঋণের ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। এতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া নিটঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই ঋণের জোগান দিতে গিয়ে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক খাত আরও চাপে রয়েছে। তারপরও আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।