Home Featured শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির বিচার না হওয়ায় আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির বিচার না হওয়ায় আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে

by fstcap

মাশরুর রিয়াজ পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তার। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে তিনি পিএইচডি করেছেন।পরে এমবিএ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়ন্স ইউনিভার্সিটি থেকে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, শেয়ারবাজার, আর্থিক খাতের সংস্কারসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন

কালবেলা: বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। অর্থনীতির কোন জায়গাগুলোতে নতুন সরকারের গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মাশরুর রিয়াজ : যে কোনো নীতিগত সংস্কারের আগে আমাদের এই মুহূর্তের পটভূমিটা বুঝতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এত বড় গণআন্দোলন কখনোই হয়নি। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ৬০০ থেকে ৭০০ শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরেছে। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে গুলি চালানো হয়েছে। আর এসব কিছুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে দেশের মানুষ।

 

এই মুহূর্তে দেশ কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এটা আমরা জানি যে, পৃথিবীর যেখানেই বিপ্লব হয়, তার পরবর্তী কিছুদিন এরকম কিছুটা বিশৃঙ্খল অবস্থা থাকে। পুলিশের কিছু অংশের কুকর্মের কারণে সমগ্র পুলিশ বাহিনী মানুষের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। দেশের দীর্ঘ ১৫ বছরের একটি শাসনের অবসান হয়েছে। সেই শাসন আমলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে অনেক জায়গায় আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

 
 

এরকম একটি জায়গায় এসে অর্থনীতির স্বার্থে এবং জাতীয় স্বার্থে প্রথম কাজ হলো শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। অতি দ্রুত দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে কারণ এর সঙ্গে অর্থনীতি ও মানুষের নিরাপত্তা জড়িত। যে গণআন্দোলনটি হয়েছে, তার সফলতার সঙ্গেও এই সবকিছু জড়িত। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা না হলে পুরো দেশের যে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন, সেটা শুরু করা যাবে না।

 

গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতিতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট, উন্নয়ন প্রকল্পসহ অন্যান্য সরকারি ব্যয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দেশের রাজস্ব, রপ্তানি থেকে শুরু করে সব তথ্যে গরমিল করা হয়েছে। এমনকি ২০১৫-১৬ সালের পর থেকে যে অর্থনৈতিক তথ্য এসেছে সেখানে কোনটার কী অবস্থা, তা কেউ জানে না। ধরে নেওয়া হচ্ছে, এখানে ব্যাপক গরমিল আছে। সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, গত ১০ বছরে ৬৩ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।

সুতরাং আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি, তা ঠিক কোথা থেকে শুরু করব তা আমরা জানি না। আগে আমাদের দেশের অর্থনীতির সত্যিকারের অবস্থা জানতে হবে। অর্থনীতির ক্ষত কতটা গভীর, তা আগে পরিমাপ করতে হবে। আর এটা করতে হবে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে। এটাই হতে হবে আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি।

দ্বিতীয়ত, আমাদের চলতি অর্থনীতিতে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। গত দুই বছর এ সমস্যাগুলো চলছে। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়মূল্য। অতিদ্রুত আমাদের এ বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। যদি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়ে, দ্রব্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পায়, তাহলে মানুষের মধ্যে আবারও অনাস্থা তৈরি হবে। সুতরাং সরকারকে এই জায়গাগুলোতে এখনই নজর দিতে হবে।

বাজার নিয়ন্ত্রণ, সাপ্লাই নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, দামের কারসাজি এবং মনোপলি এগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল। এখন সেটা নেই। সুতরাং সুযোগ এসেছে পণ্যের দাম কমানোর। দরিদ্র শ্রেণি এবং মধ্যবিত্তদের জন্য যে পণ্যসামগ্রী এবং সেবা গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত দাম কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা যেহেতু একটি আমদানিনির্ভর দেশ, এমনকি আমাদের কৃষিপণ্যও আমদানি করতে হয়; তাই দেশের রিজার্ভের দিকে নজর দিতে হবে।

তৃতীয়ত, আমরা জানি দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক অরাজকতা চলছে। এমনকি এখনো দখলদারিত্ব চলছে। এ মুহূর্তে এটা বন্ধ করতে হবে। শক্ত হাতে দমন করতে হবে। পারলে আগামীকাল থেকেই এটা বন্ধ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষমতাশালী যেসব লোক ব্যাংক খাতে থাবা বসিয়েছে, তারা যতটা সম্ভব টাকা পাচার করার চেষ্টা করতে পারে। এখনই তাদের থামানোর ব্যবস্থা না করলে আমরা অনেক বড় ক্ষতির মুখে পড়ে যাব।

চতুর্থত, সাধারণ মানুষের ভালো থাকা নির্ভর করে বেতনের ওপর। দেশের বৃহৎ অংশের মানুষ চাকরিজীবী। দেশে লাখ লাখ যুবক চাকরিপ্রার্থী। অথচ আমাদের সামনে কর্মসংস্থান কম। তাই নতুন সরকারকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে। ছোট ব্যবসা, কৃষি এবং অন্যান্য উদ্যোক্তার মাধ্যমে অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। তাদের জন্য প্রয়োজনে স্পেশাল ফান্ড একসেস এবং রেগুলেটরি ইনসেনটিভ দেওয়া যেতে পারে।

কালবেলা : বাংলাদেশের অর্থনীতির এ মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ কী?

মাসরুর রিয়াজ : গত পাঁচ-দশ বছর আমাদের অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, এখনো সে চ্যালেঞ্জগুলোই রয়েছে। অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণ, রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি—আমরা এগুলোর কথা সবসময় বলে আসছি। আমরা অনেক অবকাঠামো নির্মাণের কথা বলছি; কিন্তু অর্থনৈতিক অবকাঠামো হয়নি। এখানে ১০ বছর আগেও যেমন দুর্বলতা ছিল এখনো তেমনি আছে। এখানে পরিকল্পনা করে সংস্কারের হাত দিতে হবে।

আরেকটি বিষয়, আমরা যদি এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে বের হয়ে যাই সেটা আমাদের জন্য কতটুকু ঠিক হবে? বাস্তবে আমাদের কষ্ট বেড়ে যাবে। আমরা সব সুবিধা হারাব, ইনসেনটিভ পাওয়ার সুযোগ হারাব। আমাদের স্বাস্থ্য খাত হুমকির মুখে পড়বে। অর্থাৎ মুখে মধ্যম আয়ের দেশ বলে শান্তি পাব কিন্তু বাস্তবে সমস্যায় পড়ব। পৃথিবীতে অনেক উদাহরণ রয়েছে, যারা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হয়, আমাদেরও এটা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে। আমরাও কিছু সময়ের জন্য বা কয়েক বছরের জন্য এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দিতে পারি।

কালবেলা : অর্থনীতির কাঠামোগত কোন পরিবর্তনগুলো দরকার বলে মনে করেন?

মাশরুর রিয়াজ : গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় হয়েছে ব্যাপকভাবে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা কখনোই খুবই জোরালো ছিল না। তবে যেটুকুই ছিল, গত কয়েকটি বছরে সেখানে উন্নতির থেকে অবনতিই ঘটেছে। বেসিক ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। আজ ব্যাংকিং সেক্টরের এই যে অবস্থা তার জন্য কে দায়ী? বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করত তাহলে এ অবস্থাটা এড়ানো যেত।

আর্থিক সুশাসনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ রেগুলেশন, সুপারভিশন এবং অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত করা; কিন্তু আমাদের দেশে এই গভর্ন্যান্স ফেল করেছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাঠামোগত বিষয়গুলোতে অতিসত্বর হাত দিতে হবে। সবকিছুর আগে আসবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা। অর্থাৎ স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল সরকারের ওপরের মহল থেকে। এমনটা না করলে বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের এই ক্ষতি এতটা হতো না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সেই স্বাধীনতাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের দেশে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। আমাদের ট্যাক্স আহরণ কম। যত মানুষের টিন সার্টিফিকেট রয়েছে, তারা সবাই ট্যাক্স দেন না। কাস্টমস ও ভ্যাটে ব্যাপক হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের যে রাজস্ব আহরণ হয়, তা দিয়ে একটি সরকারের পক্ষে চলা খুব কঠিন। সামনের দিনে সরকারের খরচ আরও বাড়বে। সুতরাং আমাদের রাজস্ব খাত ঢেলে সাজাতে হবে।

আমাদের নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি সংস্কার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুর্বল। আজ যে নীতি প্রয়োজন সেটা করতে পাঁচ বছর লেগে যায়। ততদিনে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে যায়। সুতরাং আমাদের যে কোনো সেক্টরের পরিবেশ বিবেচনায় রেখে নীতি প্রণয়ন ও সংস্কার করতে হবে। খুব দ্রুত সংস্কারের নকশা প্রণয়ন এবং তা দ্রুত প্রয়োগ করতে হবে। আজ ভিয়েতনাম শুধু সঠিক নীতি সিদ্ধান্তের কারণে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের দেশের কাতারে চলে গেছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য হলো, তারা আজকের সিদ্ধান্ত আজকেই নেয়। আমরা এখানে অনেক অনেক পিছিয়ে। সুতরাং এ সিস্টেমটি একেবারে ঢেলে সাজাতে হবে।

কালবেলা : আমাদের পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি কী? এখানে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন?

মাশরুর রিয়াজ : পুঁজিবাজার ঠিক করা আমাদের কয়েকটি অগ্রাধিকারের মধ্যে অন্যতম। আমাদের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ১০ বা ১৫ বছর আগেও ছিল এবং এখনো তা রয়েছে। বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের বাজার নেই এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস নেই। অর্থনীতিতে এটাকে আমরা লং টার্ম ফাইন্যান্স বলি। আমাদের লং টার্ম ফাইন্যান্সের সংস্থান অত্যন্ত দুর্বল। ফলে অনেক বছর ধরে আমরা দুটি টার্ম পড়ছি। এখানে ক্যাপিটাল মার্কেটের সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ও জড়িত রয়েছে। আজকে ব্যাংক খাতের এই সঙ্গিন অবস্থার মূল কারণ মিস গভর্ন্যান্স। আর দ্বিতীয় কারণ পুঁজিবাজার নষ্ট করে ফেলা।

পুঁজিবাজার নষ্ট করে ফেলার কারণে অনেক ধরনের শিল্প ও ব্যবসায় বাংলাদেশে এগোতে পারছে না। আমাদের অবকাঠামো নির্মাণেও সরকারি অর্থায়নে খুব বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পাবলিক/প্রাইভেট ফাইন্যান্স।

আমাদের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের ওপর। সুতরাং এখানে আমাদের প্রাইভেট ফাইন্যান্সের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের পোশাক খাতে অনেক উন্নয়ন করতে হবে। প্রযুক্তি ছাড়া গার্মেন্টস শিল্প টিকবে না। আধুনিক মেশিন যুক্ত করতে গেলে মূলধনের প্রয়োজন, যে মূলধন দুই-তিন বছরের মধ্যে উঠবে না। সুতরাং এগুলোর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন। আর দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে আমাদের একমাত্র উৎস ক্যাপিটাল মার্কেট, যাকে আমরা সঙ্গিন করে রেখেছি।

কালবেলা : পুঁজিবাজার ঠিক করতে গেলে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?

মাশরুর রিয়াজ : আমাদের পুঁজিবাজারে ব্যাপক অরাজকতা ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রথমত এ বাজারে বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আনতে হবে। যতক্ষণ না এটা আনতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত ক্যাপিটাল মার্কেটকে কার্যকর করতে পারব না। আমরা চাই খুচরা বিনিয়োগকারীরা সুবিধা পাক; কিন্তু তারা খুশি নাকি বেজার, তাদের লোকসান হলো নাকি লাভ হলো—এটাকে কেন্দ্র করে পলিসি তৈরি করা যাবে না এবং তাদের জন্য সময় সময় পলিসি পরিবর্তন করা যাবে না। আমাদের এই সিস্টেম থেকে বের হতে হবে। আমাদের শেয়ারবাজারে প্রোডাক্টের সংকট রয়েছে। প্রোডাক্ট না থাকলে কোম্পানিকে বিনিয়োগে আকর্ষণ করতে পারব না। সুতরাং স্টক মার্কেটে প্রোডাক্ট ডাইভারসিটি প্রয়োজন।

আমাদের শুধু গার্মেন্ট সেক্টরে আড়াই হাজার রপ্তানিকারক রয়েছে। অথচ আমাদের পুঁজিবাজারে কোম্পানির সংখ্যা ২৫০টি। অর্থাৎ আমরা শুধু গার্মেন্টস সেক্টরেরই ১০ শতাংশকে পুঁজিবাজারে আনতে পারিনি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে তাদের যে ধরনের শর্তের সম্মুখীন হতে হয়, তা নিয়ে হয়তো তাদের অনাগ্রহ রয়েছে। সুতরাং আমাদের কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া এবং যুক্ত হওয়ার পরের ভালো এক্সপেরিয়েন্স দিতে হবে। তাদের কনফিডেন্স দিতে হবে।

আমাদের পুঁজিবাজারে প্রচুর পরিমাণে সুশাসনের অভাব রয়েছে। মার্কেট ম্যানিপুলেশন, ইনসাইডার ট্রেডিং, ম্যানিপুলেশনসহ নানা সমস্যা রয়েছে। কেউ ছয় মাসে ১০ টাকার শেয়ার ৪০-৫০ টাকা পেয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ তার থেকে ভালো হয়েও দেড় বছর ঝুলে থাকছে ২০ টাকা পাওয়ার জন্য। অর্থাৎ আমাদের এ সেক্টরে কোনো সুনজর নেই। এখানে দায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারের।

আরেকটি বিষয় হলো আমাদের সক্ষমতা। টুলস ও প্রসিডিউর আছে কি না, সঠিক এবং যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষগুলো আছে কি না। আমার মনে হয় এখানে ব্যাপক উন্নতির সুযোগ রয়েছে। আমি যতটুকু জানি, বিশ্বব্যাংকসহ বড় বড় উন্নয়ন সহযোগী আমাদের এ সেক্টরে সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে; কিন্তু তারা কেন আসেনি সেটা খুঁজে দেখতে হবে।

কালবেলা : পুঁজিবাজারে দুটি বড় বড় স্ক্যাম সংঘটিত হয়েছিল। বিনিয়োগ না আসার পেছনে এটাকে কি কোনো কারণ হিসেবে দেখছেন?

মাশরুর রিয়াজ : অবশ্যই আমি মনে করি আমাদের পুঁজিবাজার ধ্বংসের পেছনে এই স্ক্যামগুলোর বড় দায় রয়েছে। আমরা দেখেছি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জেও ম্যানিপুলেশন হয়েছে; কিন্তু তারা বুঝতে পারার পরপরই সেখানে সঠিক তদন্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের দেশে কয়েকটি তদন্ত হয়েছে কিন্তু সেগুলোর কোনো বিচার হয়নি। তদন্তের পর সেগুলো ধামাচাপা পড়ে গেছে। ফলে এই স্ক্যামগুলোর কারণে স্টক মার্কেটের মিনিমাম শৃঙ্খলা বা সুশাসন নিয়ে মানুষের মনে ভয় জেগেছে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের উচিত ছিল একটি জবাবদিহির উদাহরণ তৈরি করা, যা আগের সরকার করেনি। যেহেতু রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলছে আমাদের বিপ্লবের মহানায়ক ছাত্ররা ও অন্তর্বর্তী সরকার; সুতরাং এখন থেকে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচার সবকিছুর আগে থাকতে হবে।

কালবেলা : আমাদের বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

মাশরুর রিয়াজ : আমি বলব, এ ঋণের বোঝা আমাদের জন্য একটা বড় চাপ। একটি রাষ্ট্রের যে আর্থিক শৃঙ্খলা তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রায় এক দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে গর্ব করতে পারত; কিন্তু একালে এসে আর্থিক খাতকে যাচ্ছেতাইভাবে নষ্ট করা হয়েছে।

পাবলিক ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট হলো রাষ্ট্র কী ব্যয় করবে, কীভাবে ব্যয় নিরূপণ করবে, সেটা সমন্বয় করা। আমাদের মতো নিম্ন বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশকে আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়। সরকার দুটি উদ্দেশ্যে বড় বড় প্রজেক্ট নিতে পারে। একটি হলো জনগণের কল্যাণ, আরেকটি হলো নিজের লাভ। সরকারি যে কোনো কারণেই হোক, যত সম্ভব বেশি প্রজেক্ট হাতে নিতে চাইবে; কিন্তু সেটা নিতে হবে আয়ের ওপর ভিত্তি করে। আর যদি ঋণ করতেই হয় তবে সেটা ম্যানেজেবল ঋণ হতে হবে। শোধ করার সক্ষমতা থাকতে হবে।

কিন্তু আমরা দেখেছি, গত এক যুগে সরকার একের পর এক বড় বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে এবং সেখানে ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। যত উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে স্পষ্টতই অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে অপ্রয়োজনে। আবার অনেক প্রকল্প অল্প প্রয়োজনীয় বা প্রয়োজন কিন্তু তার ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। আর সেটা করতে গিয়ে যখন দেশের টাকায় হলো না তখন বলা হয়েছে আরও ঋণ নাও। এভাবে যতটুকু ঋণ বাংলাদেশ ম্যানেজ করতে পারবে, তার থেকে অনেক বেশিগুণ ঋণ নেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক ঋণকে ঋণের বোঝা বানানো হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ব্যাপক টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে এসব প্রকল্পের কাজে।

এখন আমরা এই ব্যাপক বিদেশি ঋণের বোঝা বহন করছি। সুদসহ কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। প্রতি বছর বাজেট থেকে একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। ২০২৫ সাল থেকে এই চাপ আরও বাড়বে। আমি মনে করি, অর্থনীতিতে শৃঙ্খলাতা অমান্য করে বেপরোয়াভাবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক খাতকে দুর্বৃত্তায়ন করা হয়েছে। এ অবস্থা হয়তো এখনো আমরা কিছুটা হলেও ঠিক করতে পারব। বিদেশি ঋণগুলো যতটা সম্ভব রি-নেগোশিয়েট করে সময় বাড়িয়ে নিতে হবে। রেভিনিউ বাড়াতে হবে। এক্সপোর্ট, রেমিট্যান্স এবং এফডিআই বাড়াতে হবে। এসব করতে পারলে হয়তো আমাদের সামনের দিনের অর্থনীতি একটু হলেও ভালো করতে পারব।

কালবেলা : বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগ কম কেন? বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কী করা যেতে পারে?

মাশরুর রিয়াজ : বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রতিযোগিতা করে। আমরা যতই দেখাই না কেন যে, আমাদের দেশ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য পারফেক্ট গন্তব্য, আমাদের অর্থনীতি অনেক ভালো, আমরা অনেক ভালো আছি; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, অন্য দেশগুলোও একইভাবে নিজেদের ভালো দেখাতে চেষ্টা করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারী তাদের সামনে থাকা অনেক অপশন থেকে পছন্দমতো একটি অপশন বেছে নেন। তারা চিন্তা করেন ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়ায় বিনিয়োগ করলে ভালো হবে নাকি বাংলাদেশে করলে ভালো হবে। এই প্রতিযোগিতার জায়গাটিতে আমরা যে বাংলাদেশকে প্রমোট করব, সেই পরিস্থিতি কখনোই তৈরি হয়নি।

দিন শেষে বিদেশি বিনিয়োগ আসে একটি সেক্টরের। এই জায়গাটায় আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের ভালোমানের তেমন কোনো সেক্টর নেই। আমরা খাত উন্নয়ন করতে পারিনি। আমরা অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণ করতে পারিনি। এ কারণেই আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছি না। আমাদের বিনিয়োগ পরিবেশ এখনো মান্ধাতা আমলের। প্রথমেই এই বিনিয়োগ পরিবেশ ঠিক করতে হবে। কিছু কিছু সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু সেগুলোর তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। গত কয়েকটি বছরে গভর্ন্যান্স ফেইলর এর কারণে রেগুলেটরি ব্যারিয়ার বা রেড টেপ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। আমাদের কাঠামো ঠিক নেই। কারখানার জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন জোগান নেই। বন্দরসহ দেশের লজিস্টিক সিস্টেম অপর্যাপ্ত এবং খরচ অনেক বেশি। তাই বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আগে আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশনে যেতে হবে। উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

You may also like