পাঁচ বছরের সম্পদ, ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও আর্থিক সক্ষমতা খতিয়ে দেখবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রসপেক্টাসে অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে তালিকাভুক্তি, আইপিও’র অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা মেনে না চলা, মুনাফা দেখিয়ে বাজারে এসে লোকসানে জড়িয়ে পড়াসহ বেশকিছু কারণে বিতর্কের মুখে ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বিএসইসি।
তথ্যমতে, সিলভা ফার্মার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ ও লোকসানের কারণ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি। বিএসইসির উপ-পরিচালক মাওদুদ মোমেন, সহকারী পরিচালক তš§য় কুমার ঘোষ ও মারুফ হাসানের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বিএসইসির পক্ষ থেকে তদন্তের বিষয়টি সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে।
বিএসইসির দায়িত্বশীলরা বলছেন, পুঁজিবাজার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালসের গত পাঁচ বছরের দায়-সম্পদ, আর্থিক সক্ষমতা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি ২০২০ থেকে ২০২৪ আর্থিক পর্যন্ত ৫ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে।
সূত্রগুলো বলছে, আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে তোলা অর্থের ব্যবহারের বিষয়ে তদন্ত করবে। একইভাবে তালিকাভুক্তির আগে প্রি-আইপিওর মাধ্যমে উত্তোলিত মূলধনের ব্যবহার এবং আইপিও প্রসপেক্টাসের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করবে বিএসইসি।
তালিকাভুক্তির পর থেকে বিগত ৬ বছরেও আইপিওর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। এরই মধ্যে আইপিওর অর্থ ব্যবহারে কোম্পানিটি ৫ দফা সময় বাড়িয়েছে। তবুও ওই অর্থ ব্যায় করতে ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি। এবার কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইপিওর অর্থ ব্যয়ে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরের গত ফেব্রুয়ারিতে আইপিওর অর্থ ব্যয়সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছে পিনাকী অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস আইন লঙ্ঘনের তথ্য জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লোকসানের জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে কভিড-১৯ মহামারি, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই-চেইনের বিঘ্ন ঘটা ও মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে অতিরিক্ত ব্যয়কে লোকসানের জন্য দায়ী করছে কোম্পানিটি।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনে ৪৮ পয়সা শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখিয়েছে সিলভা ফার্মা; যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১২ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরে কোম্পানিটির লোকসান ৩০ পয়সা বেড়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি নেট সম্পদমূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকা ২ পয়সায় দাঁড়িয়েছে; যা এর আগের আর্থিক বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ টাকা ৫৩ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্যও কমেছে।
এদিকে তালিকাভুক্তির পর থেকে আয় কমার কারণ দেখিয়ে নামমাত্র মুনাফা দিচ্ছে সিলভা ফার্মা। গত ৫ বছরের মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। এরপর ২০২২ সালে দুই শতাংশ কমিয়ে মাত্র ৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। আর সর্বশেষ ২০২৩ ও ২০২৪ আর্থিক বছরে বিনিয়োগকারীদের মাত্র এক শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিচ্ছে কোম্পানিটি; যার কারণে কয়েক বছর ধরেই জেড ক্যাটেগরিতে অবস্থান করছে বিতর্কিত সিলভা ফার্মা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে অনেক বিতর্কিত কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছে। স্বৈরাচারী সরকারের ১৬ বছরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দায়িত্বশীলদের অনিয়ম-জালিয়াতির কারণেই কোম্পানিগুলো বাজারে এসেছে। আর বাজারে আসার পর উত্তোলিত অর্থ সরিয়ে নিয়ে বা ভিন্ন খাতে ব্যয় করে কোম্পানিকে দুর্বল করে ফেলেছে। পরে লোকসানের জন্য বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করিয়েছে। যেসব কোম্পানির জাল-জায়িয়াতির বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বশীলরা নীরব ছিলেন। কখনও-বা তাদের প্রত্যক্ষ মদদেই সবকিছু হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। পুনর্গঠন করা হয়েছে ডিএসই-বিএসইসি। সেই সঙ্গে দুর্বল, বিতর্কিত কোম্পানির জালিয়াতির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠছে। এর জের ধরেই সিলভা ফার্মার বিষয়টি সামনে এসেছে।
২০২৪ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাববছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নামমাত্র ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জুন, ২০২৪ হিসাব বছরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ৪৭ পয়সা। আগের হিসাববছরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ২৪পয়সা । ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৫৩ টাকা।
সর্বশেষ চলতি অর্থ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২৪) কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ১৯ পয়সা । গত হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল দশমিক শ–ন¿ ৬ টাকা। অন্যদিকে, অর্ধবার্ষিক বা ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২৪) কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে দশমিক ৪৩ টাকা। গত হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল দশমিক ১২) টাকা। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভি) হয়েছে ১৬ দশমিক শ–ন¿ ২ টাকা।
সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি হয় ২০১৮ সালে। ‘বি’ ক্যাটাগরির এ কোম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধন ১৩৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ১৩ কোটি ৬৫ লাখ। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতে ৪৫.২১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে দশমিক শ–ন¿ কে শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানির স্বল্প মেয়াদি ঋণ রয়েছে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার টাকা।
https://sharebiz.net/মুনাফা-দেখিয়ে-লোকসানে-ব/
Silvaphl