● তারল্যসংকটে ভোগা কমপক্ষে পাঁচটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া ধারের টাকায় চলছে।
● আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হওয়ার পর পদ্মাসহ ১০টি দুর্বল ব্যাংকে পৃথক তদারকি শুরু করেন।
দেশের ৭-১০টি ব্যাংক একীভূত করার কথা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে সমসংখ্যক ভালো ব্যাংক রয়েছে একীভূত হওয়ার চাপে।
এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংকটে পড়া সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে এতে ভালো ব্যাংকের পরিচালক-কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কারণ, যে প্রক্রিয়ায় এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে, তাতে ভালো ব্যাংকগুলোর ওপর খারাপ ব্যাংক চাপিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। দেশের ৭-১০টি ব্যাংক একীভূত করার কথা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে সমসংখ্যক ভালো ব্যাংক একীভূত হওয়ার চাপে রয়েছে বলে জানা গেছে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আলাপ-আলোচনার বাইরে ‘অস্বাভাবিক’ কিছু করা হবে না বলে তিনি আশা করছেন।
প্রথম আলো কথা বলেছে এমন অনেক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিশেষভাবে সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের কথা উল্লেখ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা খোলাখুলিভাবেই বলেছেন যে তাঁরা বেসরকারি খাতের এই ব্যাংক নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে আছেন। কারণ, ব্যাংকটির নথিপত্রেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৯ শতাংশ। তবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ এর দ্বিগুণ হবে বলে ব্যাংকটির কর্মকর্তারাই অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একীভূত করে দেশে চালু ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তটি ভালো। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক হলেও ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা বাস্তবায়নের পথে যেতে হবে। পাশাপাশি ভালো কোনো ব্যাংকের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা করে পেশাদারির ভিত্তিতে একীভূত করার কার্যক্রম চালাতে হবে। না হলে এই উদ্যোগে ভালো ফল না-ও আনতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব ব্যাংক দুর্বল, তার তালিকা করে খারাপ সম্পদগুলো আগে আলাদা করে ফেলতে হবে। এরপর ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার আহ্বান জানালে সেটা ভালো হবে। চাপ দিয়ে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করলে তা ভালো ফল না–ও দিতে পারে।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, শুধু ব্যাংক একীভূত করেই ব্যাংক খাত ঠিক করা যাবে না। পরিবারের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক
নিয়োগ দিয়ে ব্যাংক পরিচালনার সময় এসেছে। পাশাপাশি বেনামি ঋণ ও যেসব ঋণ খেলাপি দেখানো হচ্ছে না, তা–ও খুঁজে বের করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সবক্ষেত্রে সম–আইন প্রয়োগ শুরু করতে হবে। কাউকে রেখে কাউকে ধরার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে আমানতকারীদের অর্থের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করার।
কেন ব্যাংক একীভূত
সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ব্যাংক খাত ভালো থাকার বার্তা দেওয়া হলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। ব্যাংকের নথিপত্রে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা হলেও দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা। এর বাইরে খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ বেনামি ঋণ রয়েছে বলেও মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
অনিয়মের কারণে নগদ অর্থ বা তারল্যসংকটে ভোগা কমপক্ষে পাঁচটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া ধারের টাকায় চলছে। সরকারি ও বিদেশি মালিকানাধীন কিছু ব্যাংকের বাইরেও বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংকে ১০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। এগুলো হলো এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক। এর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮৫ শতাংশের ওপর। খেলাপি ঋণ গোপন করে রেখেছে আরও এক ডজন ব্যাংক।
২০২২ সালের জুলাইয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর পদ্মাসহ ১০টি দুর্বল ব্যাংকে পৃথক তদারকি শুরু করেন। তবে এতে কোনো সুফল মেলেনি বলেই কর্মকর্তারা মনে করেন।
ব্যাংকিং খাতের সমস্যা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় উদ্যোগটি আসে অতি সম্প্রতি। গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করারও পরামর্শ দেন গভর্নর।
একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয় ৪ মার্চ ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠকেও। ওই বৈঠকে গভর্নর জানান, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে। এই আলোচনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি জানিয়ে দেয়, চলতি বছরের মধ্যে নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে চাপ দিয়ে ব্যাংক একীভূত করা হবে।
ব্যাংক খাতের সংস্কারে নানা সমস্যার সমাধান করতে গত মাসে একটি পথনকশা অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানেও ব্যাংক একীভূত করার বিষয়টি ছিল। এর মধ্যে গত সোমবার এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংক পরস্পরের সঙ্গে একীভূত হতে একটি চুক্তি করে।
পদ্মা ব্যাংক হলো ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ৯ ব্যাংকের একটির উত্তরসূরি। ফারমার্স ব্যাংক নামে এটি তখন লাইসেন্স পেয়েছিল। কিন্তু উদ্যোক্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ২০১৭ সালে এটির পর্ষদে পরিবর্তন ঘটে। আর ২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক নাম পরিবর্তন করে হয় পদ্মা ব্যাংক। সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূলধন এবং আমানতে চলা এই ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের ৬০ শতাংশই এখন খেলাপি। অন্যদিকে বড় আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। না হলে আগামী বছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূত করে দেওয়ার উদ্যোগ নেবে।
উদ্বেগে পড়েছে ভালো ব্যাংক
এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তটি হয় অনেকটা হঠাৎ করেই। বিভিন্ন সূত্র জানায়, বিভিন্ন পর্যায় থেকে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার জন্য এক্সিম ব্যাংককে প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে এত বড় আকারের ব্যাংক একীভূত না করে ছোট ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে রাজি হয় এক্সিম ব্যাংক। তখন পদ্মা ব্যাংকের দায়িত্ব নেয় এক্সিম ব্যাংক।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার হলেন ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান। এ জন্য তাঁকে দিয়েই ব্যাংক একীভূত শুরু করা হয় বলে ব্যাংকিং খাত সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, যাদের খেলাপি ঋণ কম ও মূলধন ভিত্তি ভালো, তারা একটি করে ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে পারে। ভালো হিসেবে পরিচিত এই ব্যাংকগুলোর তালিকায় রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ডাচ্–বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক।
নানা সূত্রে জানা গেছে, এসব ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালকেরা একরকম আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন। কীভাবে সবচেয়ে কম ঝুঁকি নেওয়া যায়, সেই হিসাব কষছেন অনেকে।
জানতে চাইলে এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শেষ করতে দু-তিন বছর সময় লেগে যায়। এখানে নানাবিধ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবলের প্রয়োজন হয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এটা অনেক কঠিন ও ঝামেলার কাজ। সব ব্যাংকের একীভূত করার মতো সক্ষমতাও নেই। ব্যাংক খাত ঠিক করতে এটা সময়োপযোগী উদ্যোগ। আমরাও এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। তবে আলাপ–আলোচনা করে একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে ও অস্বাভাবিক কিছু হবে না—এই আশা আমরা করি।’
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কয়েকজন ব্যাংক পরিচালক বলেছেন, এক্সিম ব্যাংকের মতো প্রভাবশালী ব্যাংককে যখন একীভূত হওয়ার প্রস্তাব মেনে নিতে হয়েছে, তখন অন্যদের পক্ষে তা এড়ানো বেশ কঠিন। এই বিষয়টি আতঙ্ক তৈরি করছে।
জানতে চাইলে প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছে বারবার একীভূত হওয়া নিয়ে জানতে চাইছে। আমরা তাদের বলছি, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না, যাতে প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়ে। আমানতকারীদের টাকায় ব্যাংক চলে, তাই ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করার কোনো সুযোগ নেই।’
তানজিল চৌধুরী আরও বলেন, ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্তটি ভালো। এ জন্য নানা ধরনের নীতি ছাড় দিতে হবে, যাতে অন্যরা আগ্রহী হয় এবং কারও ক্ষতি না হয়। তবে একীভূত করার আগে বড় প্রশ্ন, দুর্বল ব্যাংকের আর্থিক মূল্যায়ন কীভাবে হবে। ব্যাংক একীভূত করতে বিশ্বের অভিজ্ঞ মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানকে আনলে এতে স্বচ্ছতা বাড়বে।
source: prothomalo.com
bank combined banhladesh bank bb