বেআইনিভাবে দেশের ৫০ প্রতিষ্ঠানকে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)। ক্ষমতাচুত্য শেখ হাসিনা সরকারের ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের প্রভাবে কমিশনের মাধ্যমে এই ঋণ বিতরণ করা হয়। এখন এই ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। ফলে ওইসব ঋণ খেলাপিযোগ্য হলেও ব্যাংক রহস্য জনক কারণে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে না ব্যাংকটি। আবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিচ্ছে না ব্যাংকটি।
অভিযোগ উঠেরছে মোটা অংকের কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে ঋণের নামে এতো টাকা ব্যাংক থেকে সরিয়ে নিয়েছে। এসব টাকার বড় একটি অংশ বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ করেছেন অনেকে।
ব্যাংকটি গ্রাহকের ঋণ গ্রহণের যোগ্যতা এবং ব্যাংকের ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়েই বেপরোয়াভাবে ঋণ দিয়েছে। ব্যাংকটির মোট ঋণের স্থিতি ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫০ প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে ১১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ২০.৩৬ শতাংশ।
ইউসিবি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার তালিকায় রয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানি। এদের মধ্যে সাইফ পাওয়ার গ্রুপ ৭০০ কোটি টাকা, এস আলম গ্রুপ ৫৫০ কোটি টাকা, বিবিএস গ্রুপ ৩৪৫ কোটি টাকা, এসএস স্টিল ৩০০ কোটি টাকা এবং বিতর্কিত সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকোও ব্যাংকটি থেকে ঋণ নিয়েছে।
ব্যাংকটি থেকে এডব্লিউআর নামের একটি কোম্পানি ১২০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার জন্য আবেদন করে। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটিকে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র ব্যবসা টেলকোর কল সেন্টার। নিয়ন অনুযায়ী কোম্পানিটি ১০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পায় না। সেখানে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সাবেক ভূমি মন্ত্রী ও ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের ভাই রনির সঙ্গে সখ্যতার জোরেই এডব্লিউআর কোম্পানিকে এতো বেশি ঋণ দেওয়া হয়।
এবিষয়ে ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান শরীফ জহির বলেন, এমন অনেক কোম্পানি চিহ্নিত করেছি যারা ঋণ নিয়ে দিচ্ছে না। তাদের বিষয়ে বাংলাদে ব্যাংককে অবহিত করেছি।
ইউসিবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আসার পর ব্যাংকটির নানা অনিয়ম-দুর্নীতি স্পস্ট হচ্ছে। ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান ও তার ভাই আনিসুজ্জামান ব্যাংকটিকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছেন। এস আলম ও দেশের চিহ্নিত করেয়কটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা রে করে বিদেশে পাচারের অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।
ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েছে তাদের মধ্যে রূপায়ণ গ্রুপ ৩৫০ কোটি টাকা, বিবিএস গ্রুপ ৩৪৫ কোটি টাকা, এসএস স্টিল ৩০০ কোটি টাকা, জেমকন গ্রুপ ২৩৪ কোটি টাকা, ওমেক্স ইলেক্টরোড ২০০ কোটি টাকা, সিরাজ অ্যানো ইস্পাত ১৩২ কোটি টাকা, রুবী ফুড ১১৮ কোটি টাকা, ক্যাপিটাল বনানী ওয়ার্ল্ড ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
এছাড়াও ৩৭টি কোম্পানি রয়েছে যারা শত কোটি টাকার কম ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, এনাম হ্যাচারি অ্যান্ড ফিড, ইব্রাহীম এন্টারপ্রাইজ, রিলায়েবল ট্রেডিং, মাহবুব ব্রাদার্স, বেজ টেকনোলজি, দ্য বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েট, গোব ফিসারিজ, গোব ফার্মসিউটিক্যার, গোব এগ্রোভেট, মামা-ভাগ্নে টিম্বার ট্রেডার্স, কিংশুক বহুমূখী সমবায় সমিতি, ডালিয়া করপোরেশন, ইউনাইটেড ট্রেডিং, রুদ্র ট্রেডিং, এশিয়া এন্টারপ্রাইজ, শানসাইন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মেঘনা ট্রেডার্স, মঞ্জুরুল ইসলাম চৌধুরী, মেসার্স আরএস এন্টারপ্রাইজ, জুম ইন্টারন্যাশনাল, ডিএইচ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কন্সট্রাকশন, প্যাসিফিক অ্যাসেন্সিয়াল ফুড, ন্যাচারাল রাইস ব ব্র্যান্ড অয়েল কোম্পানি, প্রটেস্টার, রিসোর্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস, ট্রেডভিশন, স্প্যাস ওয়ার্কস ওয়াটার পার্ক, ইউনিভার্সাল গ্যাস অ্যান্ড গ্যাস সিলিন্ডার, রয়েল সি হর্স শিপিং, মেসার্স রোতি এন্টারপ্রাইজ, পিএইচ নেভিগেশন, ওরিয়ন টি কোম্পানি, মেসার্স তিস্তা ট্রেডিং সার্ভিস, টাঙ্গাইল হ্যাচারি ও ঈগোল রাইড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কন্সট্রাকশন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউসিবি ব্যাংক থেকে নেয়া ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। ব্যাংকটি যদি এই ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয় তবে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকটির মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে করে ব্যাংকটির শেয়ারে বিনিয়োগকৃত বিনিয়োগকারীরা তাদের কাঙ্খিত মুনাফা নাও পেতে পারে। সেক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগকারীরা এই ব্যাংকে বিনিয়োগের পরিবর্তে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
সবশেষ ২০২৩ সালে ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের ৫ শতাংশ ক্যাশ এবং ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয় ১ টাকা ৫২ পয়সা। আর ৩০ জুন, ২০২৪ সমাপ্ত দ্বিতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৪৩ পয়সা।
UCB bank