আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ সখ্যের পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্কটাও ছিল বেশ ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ ও চীনের ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বেড়েছে। দুই সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) হৃদ্যতার বিষয়টিও গোপন ছিল না।
এমন পটভূমিতে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে চীনের মধ্যে একধরনের দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা ছিল। বাংলাদেশে চলমান বৃহদায়তন প্রকল্পে যুক্ত নিজের নাগরিকদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল চীন।
অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের চীন সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা–বেইজিং সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধা, অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ অনেকটা কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সরাসরি বলেছেন, তাঁদের প্রতিবেশী কূটনীতির ‘গুরুত্বপূর্ণ স্থানে’ আছে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধা থাকবে বেইজিংয়ের।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যৎ–মুখী দিক থেকে বিবেচনা করলে তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরটিকে ঢাকা–বেজিং সম্পর্কের অনিশ্চয়তা সরিয়ে নতুন মাত্রা যোগ বলা যেতে পারে। এ সফরে বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
চীনের প্রতিবেশী কূটনীতিতে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাখার বিষয়টি জনসমক্ষে প্রথমবারের মতো বলেছে বেইজিং। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত না থাকার পরও বাংলাদেশের পাশাপাশি পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক কারণে এ ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ। সম্পর্কের পাঁচ দশকের ধারাবাহিকতায় চীন যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, এ ঘোষণায় তার প্রতিফলন আছে। আবার দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ পেরিয়ে ৫১ বছর থেকে নতুন যাত্রা শুরুর জন্য কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের কথা উচ্চারিত হয়েছে তৌহিদ হোসেনের চীন সফরে। বাংলাদেশের নাজুক স্বাস্থ্যসেবা খাতে সহায়তায় এগিয়ে এসে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো, শিল্প স্থানান্তরের মাধ্যমে বাণিজ্য বাড়ানো এবং ঋণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছাড়ের নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়টিও স্পষ্ট।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যৎ–মুখী দিক থেকে বিবেচনা করলে তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরটিকে ঢাকা–বেজিং সম্পর্কের অনিশ্চয়তা সরিয়ে নতুন মাত্রা যোগ বলা যেতে পারে। এ সফরে বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি চীনের রাজনৈতিক সমর্থনের জোরালো বার্তাও আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল ঘিরে বেইজিং–ওয়াশিংটন সম্পর্কের কৌশলগত পরিবর্তন আসছে। যার রেশ পড়বে বিশ্বের নানা দেশে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো পরাশক্তির দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থেকে বাংলাদেশকে একধরনের ভারসাম্য রেখে চলতে হবে।
অবশ্য চীন সফরের সময় চায়না মিডিয়া গ্রুপ বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রতিটি সরকার চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তিনি বলেন, ‘আমি এটুকু সফলভাবে বোঝাতে পেরেছি (চীন সরকারকে), আমাদের সরকার অন্তর্বর্তী সরকার, হয়তো দীর্ঘ সময় থাকবে না। (দুই দেশের) সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় আমরা যেসব সিদ্ধান্ত নেব, সেগুলো পরবর্তী সরকার ঠিকমতো অনুসরণ করে যাবে। সম্পর্কের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়, আমি এটা চীনা কর্তৃপক্ষকে অনুধাবন করাতে পেরেছি।’
বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই নীতিগতভাবে বাংলাদেশের জন্য ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে রাজি হলেও তা সব প্রকল্পের জন্য হবে, এমনটি নয়। মূলত সুদের হার কমানো, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো এবং প্রকল্পে অর্থায়নের পরিমাণের হার বাড়ানো—সব ক্ষেত্রেই প্রকল্প অনুযায়ী চীন সিদ্ধান্ত নেবে।
নতুন মাত্রা দেবে স্বাস্থ্যসেবা
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও ও চীনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থার (সিডকা) চেয়ারম্যান লুয়ো ঝাউহুইয়ের সঙ্গে তৌহিদ হোসেনের আলোচনায় স্বাস্থ্যসেবায় নতুন সহায়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঢাকার পূর্বাচলে এক হাজার শয্যার বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবকে চীন স্বাগত জানিয়েছে। চীনের অর্থায়নে দুই দেশের মধ্যে প্রথম মৈত্রী হাসপাতালটি পরিচালিত হবে চীনা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে। যেহেতু নতুন হাসপাতাল নির্মাণে কয়েক বছর লাগবে, আগস্ট–পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও লোকজনের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কুনমিংয়ের অন্তত চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশের নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে অনুরোধ জানায় ঢাকা। চীন এ অনুরোধ রাখার কথা এ সফরেই জানিয়েছে। প্রয়োজন হলে কুনমিংয়ের পাশাপাশি চেংদুতে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য বিশেষায়িত কিছু হাসপাতালে সেবা দেওয়ার আশ্বাসও চীন দিয়েছে।
ঋণের ক্ষেত্রে ছাড় সামগ্রিক নয়
সিডকা চেয়ারম্যান লাও ঝাওহুইয়ের সঙ্গে বৈঠক চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশে পরিচালিত প্রকল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি সিডকা চেয়ারম্যানকে ক্রেতার অগ্রাধিকারমূলক ঋণ (পিবিসি) ও সরকারি ছাড়কৃত (জিসিএল) ঋণের সুদের হার ২–৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছর থেকে ৩০ বছর করার বিষয় বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি বাংলাদেশে চীনা ঋণের প্রতিশ্রুতি ফি এবং ব্যবস্থাপনা ফি মওকুফ করারও অনুরোধ করেন। সিডকা চেয়ারম্যান বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েছেন এবং সুদের হার আরও কমানোর বিষয়ে বিবেচনা করবেন। তৌহিদ হোসেন বাংলাদেশে বাস্তবায়িত সিডকার ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোয় অর্থায়নের পরিমাণের হার বাড়ানোর অনুরোধ করেন।
বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই নীতিগতভাবে বাংলাদেশের জন্য ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে রাজি হলেও তা সব প্রকল্পের জন্য হবে, এমনটি নয়। মূলত সুদের হার কমানো, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো এবং প্রকল্পে অর্থায়নের পরিমাণের হার বাড়ানো—সব ক্ষেত্রেই প্রকল্প অনুযায়ী চীন সিদ্ধান্ত নেবে।
আমি এটুকু সফলভাবে বোঝাতে পেরেছি (চীন সরকারকে), আমাদের সরকার অন্তর্বর্তী সরকার, হয়তো দীর্ঘ সময় থাকবে না। (দুই দেশের) সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় আমরা যেসব সিদ্ধান্ত নেব, সেগুলো পরবর্তী সরকার ঠিকমতো অনুসরণ করে যাবে।
তৌহিদ হোসেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তর
গত সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে শিল্পকারখানা স্থানান্তরের কথা বলছে চীন। এবারের সফরেও প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছে। তৌহিদ হোসেন এর ধারাবাহিকতায় সাংহাইয়ে একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি, রোবোটিকস ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা দেখতে যান। সাংহাইয়ের বণিক সমিতির সঙ্গেও এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বেইজিংয়ে তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আলোচনায় সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও বলেছেন, চীনের কারখানা স্থানান্তর করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে চীন থেকে ভিয়েতনামে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। চীনের নেতারা বাংলাদেশকে তাঁদের কারখানা স্থানান্তরের জন্য বেশ উপযুক্ত মনে করছেন। কারণ, বাংলাদেশ থেকে পণ্য উৎপাদন করে অন্য দেশে রপ্তানির সুবিধা এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনার মতো উপাদানগুলো চীনের জন্য সহায়ক হবে।
চীনের ঋণে ১০টি উড়োজাহাজ কেনা
চীনের তিনটি বড় উড়োজাহাজ পরিচালনা সংস্থার মধ্যে অন্যতম চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনস তাদের ১০টি উড়োজাহাজ বিক্রি করতে চায়। ব্যবহার করা এসব উড়োজাহাজ হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রির বিষয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে চীন। এবার সফরে উড়োজাহাজ বিক্রির প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছিল। সিডকার দেওয়া ছাড়কৃত ঋণ ও অনুদানের টাকায় উড়োজাহাজগুলো বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে চীন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের আলোচনার পর বিষয়টির সুরাহা হবে।
রাজনীতি ও সংস্কারে সহায়তা
তৌহিদ হোসেন এমন এক সময়ে চীনে গেলেন, যখন সংস্কার ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিয়ে বাংলাদেশ ঘিরে মনোযোগ আছে। খুব সংগত কারণেই তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আলোচনায় ওয়াং ই এবং লিউ জিয়ানছাও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার কোন কোন খাতে কীভাবে সংস্কার করতে চায়, এ নিয়ে সবশেষ অগ্রগতি ও নির্বাচন নিয়ে কী পরিকল্পনা, তা তুলে ধরেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
চীনের নেতৃত্ব দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের জনগণের মতকে শ্রদ্ধা করে। এ জন্য বাংলাদেশের বিষয়ে নাক গলানোর কোনো ইচ্ছে তাদের নেই। বাংলাদেশের বিগত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল চীন। এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও কাজ করছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সঙ্গেও যুক্ত আছে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিপস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে চীনের ইতিবাচক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। চীনের সহায়তায় এ দেশের মুখ থুবড়ে পড়া স্বাস্থ্য খাতে বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। কুনমিংয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য পর্যটনের দ্বার উন্মোচনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় ভারতের ওপর নির্ভরতা কমে আসতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র–চীনের সম্পর্কের সমীকরণের কারণে বাংলাদেশ যেন পরাশক্তির দ্বন্দ্বের মধ্যে না পড়ে, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে বলে মনে করেন তিনি। https://www.prothomalo.com
bangladesh chaina relation