April 11, 2025 11:08 am
Home Finance শিবলীর কারণে ৫০ কোটি টাকা গচ্চা

শিবলীর কারণে ৫০ কোটি টাকা গচ্চা

by fstcap

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো ও পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে বিভিন্ন দেশে রোড শো শুরু করেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। কিন্তু এ উদ্যোগে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়া তো দূরের কথা, উল্টো আরও কমেছে। সেই সঙ্গে ক্রমশ দুর্বল হয়েছে পুঁজিবাজার। 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে রোড শো আয়োজনের নামে অর্থ পাচার এবং পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলের নামে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। প্রথম থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীর না থাকার পরও রোড শো চালিয়ে যাওয়ায় বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে। আর এ অর্থের জোগান দিতে বিভিন্ন কোম্পানিকে বাধ্য করা হতো। কাউকে কাউকে দেওয়া হয়েছে অনৈতিক সুবিধা। যেমনÑ রোড শোতে পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে অনৈতিক সুবিধা পেয়েছে ‘নগদ’। তাদের অভিযোগ, শিবলী কমিশনের নিজস্ব স্বার্থের কারণে পুঁজিবাজারের সব প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। 

এ বিষয়ে মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশিকুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘রোড শোর নাম করে কমিশন অর্থ অপচয় করেছে। রোড শোগুলোতে বাংলাদেশি ছাড়া বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারী উপস্থিত ছিল না। রোড শোতে যদি কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী আসত তাহলে তো তার প্রমাণ বাজারেই দেখা যেত। বিদেশি বিনিয়োগ তো বাড়েনি। উল্টো কমেছে। পুঁজিবাজারে যদি বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকে তাহলে এসব রোড শো দিয়ে কিছু হবে না। অযথা টাকা নষ্ট করা হয়েছে।’

জানা যায়, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রথম রোড শো অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের বেশিরভাগ দেশীয় মধ্যস্থতাকারী, ব্যবসায়ী ও অনাবাসী বাংলাদেশি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে এ আয়োজন হলেও সেখানে বিদেশিদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। এরপরও পর্যায়ক্রমে ১১টি দেশে ১৭টি রোড শো করেছিল বিএসইসি। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের বেশিরভাগ অর্থ জোগান দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারীর মালিকানাধীন তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে। সে অনুষ্ঠানগুলোতেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি ছিল অতি নগণ্য।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, ‘বিনিয়োগ আকর্ষণের নামে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোড শোর নামে রাষ্ট্রের কত টাকার ক্ষতি করেছেন এবং এর মাধ্যমে বিদেশে কত অর্থ পাচার করা হয়েছে, তার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানাই। সরকার একটি তদন্ত কমিটি করে যেন বিষয়টি প্রকাশ করে এবং তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসে।

রোড শোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো রোড শোর পৃষ্ঠপোষকতা করতে অন্তত ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। বিভিন্ন কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপে তাদের এই অর্থ দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।

কিন্তু বিনিয়োগযোগ্য কোম্পানি ও সুশাসনের অভাব, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনের কারণে ব্যয়বহুল রোড শো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এভাবে শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ ব্যয় করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিএসইসি বাজারে কারসাজি বন্ধ করতে না পারায় অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী গত তিন বছরে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে পুঁজিবাজারের বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে।

রোড শোর কারণে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে কিন্তু এর কোনো প্রভাব পড়েনি পুঁজিবাজারে। তাহলে কি যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ উদ্যোগ নিয়েছিল। এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এভাবে রোড শো আয়োজন করা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব নয়। তারা যে প্রক্রিয়ায় রোড শো আয়োজন করেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যখন একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা তার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সুবিধা নেয়, তখন এটি কীভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সবচেয়ে বড় কথা, বিএসইসি তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্থ ব্যবহার করেছে, যা শেষ পর্যন্ত শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ এবং এটি কোম্পানিগুলোর মুনাফায় প্রভাব ফেলেছে। রোড শো বিনিয়োগকারীদের উপকারে আসেনি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পুঁজিবাজারে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমেছে ১১ কোটি ১০ লাখ (১১১ মিলিয়ন) ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। তথ্য অনুযায়ী, বিএসইসি একাই তিনটি দেশে সাতটি রোড শো আয়োজন করেছিল। অবশ্য অনেক সমালোচক বলেছিলেন, এ ধরনের রোড শো হোস্ট করা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব নয়। পরে তারা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে হাত মেলায়।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম রোড শোয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিল ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ। এটি একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান। পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজকে বিএসইসি নিয়ন্ত্রণ করে, যা নিয়ন্ত্রকের জন্য পরিস্থিতি অস্বস্তিকর করে তোলে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের চারটি শহরে যৌথভাবে রোড শোর পৃষ্ঠপোষকতা করে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন ও মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান নগদ।

‘নগদ’ রোড শোর পৃষ্ঠপোষকতা করায় বাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও জিরো কুপন বন্ড ইস্যু করে ৫১০ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদন পায়। সুইজারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটি শহরে ওয়ালটন এবং যুক্তরাজ্যের দুটি শহরে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় রোড শো অনুষ্ঠিত হয়। প্রাণ গ্রুপ, আলিফ গ্রুপ, গ্রীন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স এবং এমারেল্ড অয়েলের স্বত্বাধিকারী মিনোরি বাংলাদেশও বেশ কয়েকটি রোড শো পৃষ্ঠপোষকতা করে।

পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ ও সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশের যৌথ সহায়তায় ফ্রান্স, জার্মানি ও বেলজিয়ামে রোড শো অনুষ্ঠিত হয়।

বেশ কয়েকটি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুরোধ করায় তারা পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি হয়েছিলেন। তাদের যুক্তি, তারা চাপে পড়ে এটা করেছে, কারণ কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ন্ত্রকের সংস্থার অনুরোধ এড়াতে পারে না। তারা বলেছেন, বিএসইসি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে বলেছিল, তিনি এসব অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করলে খুশি হবেন।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত একটি রোড শো আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা প্রায় দেড় লাখ ডলার খরচ করেছে। সব খরচ বহন করে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি। বিষয়টি নিশ্চিত করে ইবিএলের একজন শীর্ষ কর্তা। এ ছাড়া তারা যুক্তরাজ্যের রোড শোতে পৃষ্ঠপোষকতায় আড়াই লাখ পাউন্ড এবং দুবাই রোড শোতে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে, যা বহন করে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)। 

যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করতে বলে, তখন তা উপেক্ষা করার সুযোগ থাকে না বলে জানিয়েছে ওয়ালটন, ইউসিবি, ডিএসই ও সিএসইর পক্ষ থেকে। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় কমাতে ও বিদেশ ভ্রমণ সীমাবদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার পরও বেশ কয়েকটি রোড শো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জুলাই মাসে ব্রাজিলে আরও একটা রোড শো করার কথা ছিল। দেশের পরিস্থিতির কারণে সেই রোড শো বাতিল করে বলে জানা গেছে।

উপরন্তু রোড শো করা সত্ত্বেও বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। এদিকে রোড শোর ব্যর্থতা ঢাকতে বিদেশি পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশ্যে প্রকাশ না করতে ডিএসইকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি।

শিবলী চেয়ারম্যান থাকার সময়ে, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীও বাজারে প্রবেশ করেননি। উল্টো প্রায় ৯০০ বিদেশি বিনিয়োগকারী চলে গেছেন। ডিএসই বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৭৯, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে ২ হাজার ৫৯৯ তে নেমে এসেছে।

পুরো ঘটনা জানিয়ে এ পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ. বি. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশে তো এমনিতেই বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলে তৎকালীন বিএসইসি রোড শোর নামে টাকা অপচয় করেছে। এখন এই রোড শোর কারণে বিনিয়োগ তো বাড়েইনি বরং আরও কমেছে।’ 

তিনি বলেন, ‘গত দুই-তিন বছর থেকেই কমছে। সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। কোনো কমিশন এভাবে রোড শো করতে পারে কি নাÑ বিষয়টা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। রোড শো সাধারণত কোম্পানিগুলো করে থাকে। কিন্তু এখানে বিএসইসি করছে। বাজারে সার্বিক অবস্থা খারাপ। এমতাবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ আনা খুবই কঠিন। বাজারে যদি আস্থার জায়গা সৃষ্টি হয় তাহলে হয়তো বিনিয়োগ আসবে।’     protidinerbangladesh.com

bangladesh sharebazar

You may also like