রাজধানীর বাংলামোটরের রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারের ১১ তলায় ৫ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসের প্রধান কার্যালয়। মার্চেন্ট ব্যাংকটি ২০১৩ সালে এ জায়গা প্রতি বর্গফুট কিনেছিল ৩০ হাজার ২২৬ টাকা দরে, যখন রূপায়ণ বিক্রি করছিল ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা দরে। ২০১৭ সালে পাশের আরও সাড়ে ৬ হাজার বর্গফুট জায়গা কিনেছিল ৪২ হাজার ২৫৯ টাকা দরে, যখন রূপায়ণই ১০ তলায় বিক্রি করে ১৭ হাজার টাকায়। সমকালের অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অবিশ্বাস্য দরে স্পেস কিনে কেন নিজের লোকসান করেছে প্রতিষ্ঠানটি। উত্তর মিলেছে কর্মকর্তাদের মুখেই। মার্চেন্ট ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু বকরের ভাষায়, ‘এটি হয়েছে ঊর্ধ্বতনের ইচ্ছায়।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তারা জানান, এই ঊর্ধ্বতন হলেন সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির, যার ইচ্ছাই ছিল শেষ কথা।
বাংলামোটরের মতো স্থানে কর ও নিবন্ধন খরচ ছাড়াই অবিশ্বাস্য ৪২ হাজার টাকা বর্গফুট দরে স্পেস কেনার কথা অস্বীকার না করে উল্টো সেই সময়ের বাজার মূল্যের তুলনায় কমেই কিনেছেন বলে দাবি আলমগীর কবিরের। রূপায়ণ তখন ৬০ হাজার টাকা দরে বিক্রি করছিল– এমন দাবিও তাঁর। অথচ ১৭ হাজার টাকার বেশি দরে এ ভবনের কোনো স্পেস বিক্রি হয়নি– জানিয়েছেন ভবন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে ভবনটির সাততলার ৪ হাজার বর্গফুটের একটি স্পেসের মালিক ১৭ হাজার টাকা বর্গফুট দরে বিক্রি করতে চাচ্ছেন।
শুধু রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারই নয়, ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এবং চট্টগ্রামের মোমিন রোডে বাজার দরের তিন থেকে চার গুণে বাণিজ্যিক স্পেস কেনা হয়েছে মার্চেন্ট ব্যাংকটির নামে। ব্যবসা কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ার পরও গাজীপুরে বাজারদরের তুলনায় বেশি মূল্যে ১০৯ কাঠা জমি কিনেছে, যা খালি পড়ে আছে এক দশক। ধারণা করা হয়, এসব স্পেস ও জমি কেনায় লুট হয়েছে ৫০ কোটি টাকা।
এখানেই শেষ নয়। ফ্লোর স্পেস কেনায় হরিলুটের সুযোগ নিয়েছেন মার্চেন্ট ব্যাংকটির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। আলোচিত শেয়ার কারসাজির হোতা আবুল খায়ের হিরোসহ কয়েকজনের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশে গেল কয়েক বছরে মূলধনি লোকসানি (নেগেটিভ ইক্যুইটি) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আরও প্রায় ২০০ কোটি টাকা লুট হয়েছে। এর বেশ কিছু আলামত পেয়েছে সমকাল। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হদিস না থাকা গ্রাহকের মূলধনি লোকসানি অ্যাকাউন্টে ইচ্ছামতো ঋণ বাড়িয়ে কারসাজির শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে। প্রথমে দর বাড়াতে শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে। পরে কেনা হয় কারসাজি চক্রের উচ্চ দরের ‘ডাম্পিং’ করতে, যার ব্যাখ্যা নেই তাদের। অভিযোগ, কারসাজির চক্র থেকে শেয়ারপ্রতি উপরি নিয়েছেন।
আবার কর্মকর্তারা নিজেরাও আত্মীয়ের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ার ব্যবসা করছেন। নানা সূত্রে তাদের বেনামি বা আত্মীয়ের নামে ২০টির অধিক বিও অ্যাকাউন্টের তথ্য মিলেছে। যেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সিংহভাগের লোকসান, সেখানে তাদের সব অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। মুনাফা বাড়াতে যথেচ্ছ ঋণ নিয়েছেন। ঋণযোগ্য নয়, এমন অ্যাকাউন্টেও ঋণ দিয়েছেন তারা।
প্রতিষ্ঠানটির যেসব কর্মকর্তার নামে এমন গুরুতর অভিযোগ, তাদের অন্যতম ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু বকর, চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) হুমায়ূন কবির, হেড অব কমপ্লায়েন্স ইবনে রিয়াজ, পোর্টফোলিও ম্যানেজার এফএভিপি রাজীব আহমেদ। এ ছাড়া সুবিধাভোগীদের তালিকায় আলমগীর কবিরের নানা অপকর্মের অনুঘটক বে লিজিংয়ের কর্মকর্তা মফিজউদ্দিনেরও নাম মিলেছে।
কারসাজি চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে শেয়ার কেনাবেচার কারণে প্রতিষ্ঠানটির মূলধনি লোকসানি অ্যাকাউন্টগুলোর লোকসান আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ২০১৮ সালের শেষে যেখানে অনধিক ২০০ অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসানি ছিল ২০০ কোটি টাকার কম, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে ৩৯৪ কোটি টাকা দাঁড়ায়। এখন পাঁচ শতাধিক অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসান ৪৫০ কোটি টাকার বেশি।
এমন হরিলুটের পরও চেয়ারম্যান (সাবেক) সবকিছু জানেন বিধায় সাউথইস্ট ব্যাংকের পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা বিভাগ কখনও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। প্রতিষ্ঠার পর ২০১০ সাল থেকে নিরীক্ষক হিসেবে কাজ করা পিনাকী অ্যান্ড কোং কোনো পর্যবেক্ষণ দেয়নি। এমনকি দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসিও চুপ ছিল।
অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামও কারসাজির হোতা আবুল খায়ের হিরোর মাধ্যমে বেনামে (জাবেদ এ মতিন নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে) এই প্রতিষ্ঠানে শেয়ার ব্যবসা করে বড় অঙ্কের মুনাফা নিয়েছেন, বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটির অপকর্ম ধামাচাপা দিতে সহায়তা করেন। তবে আলমগীর কবির চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার পর সাউথইস্ট ব্যাংক এখন তদন্তে নেমেছে। বিএসইসিও তদন্ত করেছে।
গত ৬ নভেম্বর মার্চেন্ট ব্যাংকটির এমডি আবু বকর এবং সিওও হুমায়ূন কবিরের কাছে সুনির্দিষ্ট অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এমডি আবু বকর সমকালকে বলেন, ‘লোকসানি অ্যাকাউন্টের লোকসান কমাতে গিয়ে উল্টো ফল হয়েছে।’ উল্টো ফল হচ্ছে দেখে, তা কেন থামাননি– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কী হয়, তা তাঁর পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।’ মাসে বা বছরেও কী দেখা সম্ভব হয়নি– এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি। অনিয়মের দায় কী এড়াতে পারেন– এমন প্রশ্নে বলেন, ‘অনিয়ম কিছু হলে দায় তো নিতে হবে।’
জানা গেছে, নানামুখী তদন্ত শুরুর পর সম্প্রতি এমডি আবু বকর এখন চাকরি ছাড়ার আবেদন করেছেন।
গ্রাহকের খবর নেই, শতকোটি টাকার লেনদেন
১৬০৫৫৩০০৪৭৪৩৬৬১৩ নম্বরের বিও অ্যাকাউন্টটি আজাদুর রহমান নামের এক বিনিয়োগকারীর। ২০১০ সালে মার্জিন ঋণ সুবিধা নিয়ে খোলা এ অ্যাকাউন্টে তিনি ২ কোটি ২৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা জমা দিয়ে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা তুলেছিলেন। ওই বছর শেষে শেয়ারবাজারে ধস নামলে আসল ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন। কারণ, দর পতনে শেয়ারের দর এতটাই কমেছিল, সব শেয়ার বিক্রি করেও সুদসমেত মার্জিন ঋণই শোধ করা সম্ভব ছিল না। ফলে ২০১৩ সালের পর আজাদুর রহমান কখনোই এ অ্যাকাউন্টির আর খোঁজ রাখেননি। তবে অ্যাকাউন্টি অদ্যাবধি বন্ধ হয়নি। গ্রাহকের অনুমতি ছাড়াই গত এক যুগ ধরে এ অ্যাকাউন্টে শেয়ার কেনাবেচা চলছে। কাজটি নিজ দায়িত্বে করছেন মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। গ্রাহকের বিনিয়োগ বা মার্চেন্ট ব্যাংকের ঋণের টাকা ফিরে পেতে নয়, স্রেফ শেয়ার কারসাজির চক্রকে সুবিধা দিতে অ্যাকাউন্টি ব্যবহার হয়েছে।
২০১৮ সালের শেষের তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে, ওই সময় এ অ্যাকাউন্টে থাকা সব শেয়ারের ক্রয়মূল্য ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যার বাজার মূল্য ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। তখন পর্যন্ত সাকল্যে মূলধনি লোকসান ছিল ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। গত ছয় বছরে একটি টাকাও জমা বা উত্তোলন হয়নি। তবু গত আগস্ট শেষে মূলধনি লোকসান বেড়ে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
গত ছয় বছরে শেয়ার কেনাবেচার সব তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে, গ্রাহককে অন্ধকারে রেখে ২০১৯ সাল থেকে তালিকাভুক্ত ৫৫টি কোম্পানির ১৫৩ কোটি টাকার শেয়ার কিনে ১৩৭ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন কর্মকর্তারা। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত আজাদুর রহমানের অ্যাকাউন্টে শুধু প্রগতি লাইফেরই শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে। এ সময়ে সর্বাধিক প্রায় ৩৬ কোটি টাকায় প্রগতি লাইফের শেয়ার কিনে ২৮ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এই শেয়ার কেনাবেচায় এখন পর্যন্ত লোকসান অন্তত ৫ কোটি টাকা।
আজাদুর রহমানের অ্যাকাউন্টে প্রগতি লাইফের শেয়ার কেনাবেচায় যেখানে বড় লোকসান হয়েছে, সেখানে দুই দফায় এ শেয়ারের দর নিয়ে ব্যাপক উল্লম্ফন হয়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবর শেষে প্রগতি লাইফের শেয়ার দর ৬৬ টাকা থেকে পরের তিন মাসে বেড়ে ১৬১ টাকা এবং চলতি বছরের এপ্রিলের ১০০ টাকা থেকে গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ২৩৯ টাকায় উঠেছিল।
আবার শুধু প্রগতি লাইফ নয়, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ফরচুন সুজের ৩২ কোটি টাকার শেয়ার কিনে পৌনে ২৯ কোটিতে বিক্রি করায় ৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের সোয়া ২২ কোটি টাকার শেয়ার কিনে ২০ কোটিতে বিক্রি করায় লোকসান সোয়া ২ কোটি টাকা। আইপিডিসির সাড়ে ৩ কোটি টাকায় কেনা অর্ধেক মূল্যে বিক্রি হয়েছে।
মূলধনি লোকসানে পড়ায় ২০১১ সাল থেকে আজাদুর রহমানের অ্যাকাউন্টে শেয়ার কিনতে নতুন করে ঋণ দেওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। কিন্তু বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকার ঋণ দিয়ে শেয়ার কেনাবেচা করা হয়েছে। এতে গ্রাহকের মাধ্যমে লোকসানের বোঝা বেড়েছে খোদ প্রতিষ্ঠানটির।
মার্চেন্ট ব্যাংকটির সবচেয়ে বেশি মূলধনি লোকসানি অ্যাকাউন্টধারী আজাদুর রহমান সমকালকে জানান, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর বড় লোকসান হলে তিনি এ অ্যাকাউন্টটির আর কোনো খোঁজখবর রাখেননি। এ অ্যাকাউন্টের শেয়ার কেনাবেচার কোনোটি তাঁর নির্দেশে হয়নি।
এক আজাদুর রহমানের অ্যাকাউন্ট নয়, এমন শত শত মার্জিন অ্যাকাউন্ট সাউথইস্ট ক্যাপিটাল সার্ভিসেস নামক মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা শেয়ার কারসাজির চক্র ও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন।
এমনই আরেক অ্যাকাউন্ট শেখ মো. নাজমুল হোসেনের (বিও ১৬০৫৫৩০০৪৭৪৩৪৩৫১)। এই মার্জিন অ্যাকাউন্টে ১৬ লাখ টাকা জমা করে এখনও এক টাকাও তোলেননি তিনি। ২০১৮ সালের শেষে এ অ্যাকাউন্টে যেখানে মূলধনি লোকসান ছিল ৮১ লাখ টাকা, গত সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। এ অ্যাকাউন্টে ৬১ টাকা দরে আরএসআরএম স্টিলের শেয়ার কিনে ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে প্রগতি লাইফ ও ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের পৌনে ৫ কোটি টাকার শেয়ার এখন ৩ কোটি ৯০ লাখে নেমেছে। অ্যাকাউন্টটিতে বিডিকম, আইপিডিসি, ফরচুন সুজ, জেনেক্স ইনফোসিস, সোনালি পেপার, প্রগতি লাইফ এবং ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ক্রমাগত কেনাবেচা করা হয়েছে, যার সবকটি নিয়ে কারসাজি করেন আবুল খায়ের হিরো।
একই তথ্য মিলেছে হেলাল উদ্দিন তালুকদারের (বিও নং- ১৬০৫৫৩০০৪৭৪৩৬৯৭১) অ্যাকাউন্টে। ২০১৮ সালের শেষে তাঁর পোর্টফোলিওতে থাকা মাত্র ৪৩ হাজার টাকার শেয়ার এবং ৪৭ লাখ টাকার মূলধনি লোকসান ছয় বছর পর প্রায় ৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। সীমান্ত বিশ্বাস নামে এক অ্যাকাউন্টের ২০১৮ সালের শেষে পোর্টফোলিওতে মাত্র ১৬ লাখ টাকার শেয়ারের বিপরীতে ২১ লাখ টাকার মূলধনি লোকসান ছিল। ছয় বছর পর প্রগতি লাইফ এবং ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের সাড়ে ৫ কোটি টাকার শেয়ার থাকার পরও মূলধনি লোকসান সাড়ে ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
আলোচিত-সমালোচিত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নামে এই মার্চেন্ট ব্যাংকেও একটি অ্যাকাউন্ট আছে। গত বছরের শেষে এ অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসান ছিল ৬০ লাখ টাকা, যা এখন ২ কোটি টাকা। তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিসেরও একটি বিও অ্যাকাউন্ট আছে। কোম্পানিটি ১১ কোটি ১০ লাখ টাকা জমা করে এখন পর্যন্ত এক টাকাও তোলেনি। তার পরও গত বছরের শেষে নিজস্ব মূলধন কমে ৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা নেমেছিল। এখন অ্যাকাউন্টটির মূলধনি লোকসান সাড়ে ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১০ মাসেই প্রায় ১৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
গ্রাহক হেলাল উদ্দিন জানান, গত ১০ বছরের বেশি সময় এ অ্যাকাউন্টে নিজে কেনাবেচা করেননি। রাজীব নামে এক অফিসার আবুল খায়ের হিরোর সঙ্গে মিলে কারসাজির শেয়ার কেনাবেচা করেন বলে শুনেছেন।
বিএসইসিকে মিথ্যা তথ্য
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে মার্চেন্ট ব্যাংকটির মার্জিন ঋণ গ্রহণকারী পাঁচ শতাধিক গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসান ছিল ৩৯৫ কোটি টাকা। যদিও সম্প্রতি বিএসইসিকে লিখিতভাবে মার্চেন্ট ব্যাংকটি জানিয়েছে, ২৭২ গ্রাহক অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসান ছিল মাত্র ৭৯ কোটি টাকা।
অথচ সাউথইস্ট ব্যাংকের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেই উল্লেখ আছে, ওই বছরের শেষে মার্চেন্ট ব্যাংকটি বহু মার্জিন ঋণ গ্রাহক অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসানের বিপরীতে ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা প্রভিশন করেছে, যা মূলধনি লোকসানের ৫ শতাংশ। এ হিসাবে মূলধনি লোকসান ছিল ১৩৮ কোটি টাকা। আবার ২০২২ সালের ১৫ শতাংশ হিসাবে ১৮ কোটি টাকা প্রভিশন করায়, ওই বছর মূলধনি লোকসান ছিল ১২১ কোটি টাকা।
মূলধনি লোকসান বিষয়ে বিএসইসিকে কেন মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে– জানতে চাইলে মার্চেন্ট ব্যাংকটির এমডি এবং সিওও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তাদের দাবি, মিথ্যা নয়, গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ বাদে তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবে সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুদ ছাড়াই গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসানের পরিমাণ ১৬০ কোটি টাক
লোকসানি অ্যাকাউন্ট হিরোর ডাম্পিং গ্রাউন্ড
গ্রাহক আজাদুর রহমানের অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন ৯৩ টাকা দরে ফরচুন শুজের ৬ লাখ ৩৩ হাজার শেয়ার ব্লক মার্কেট থেকে কেনা হয়, যার দাম ছিল ৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা। শেয়ারগুলোর বিক্রেতা ছিলেন কাজী সাদিয়া হাসান, যিনি সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং শেয়ারবাজারে কারসাজির অন্যতম হোতা আবুল খায়ের হিরোর স্ত্রী। এর তিন-চার দিন পরই ফরচুন শুজের শেয়ারই একাধিক দিনে শেয়ারপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা কমে পাবলিক মার্কেটে বিক্রি করা হয়েছে। অর্থাৎ এক লেনদেনেই লোকসান ৩০ লাখ টাকার বেশি। একই বছরের ২৯ মার্চে হিরোর অ্যাকাউন্ট থেকে ফরচুন শুজের সাড়ে তিন লাখ শেয়ার ১৩৬ টাকা দরে মোট পৌনে ৫ কোটি টাকায় কেনা হয়। ওই দিন ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ শেয়ার বিক্রি করা হয় ১৩১ টাকা দরে। এভাবে অ্যাকাউন্টগুলোর লোকসানের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। মূলধনি লোকসানি অ্যাকাউন্টগুলোর বেশির ভাগ লেনদেনে ‘কাউন্টার পার্ট’ কারসাজির চক্রের কেউ।
নিজেকে ঋণ দিয়েছে, তাও লোকসানে
রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি থেকে ৩৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছে মার্চেন্ট ব্যাংকটি, যার বিও নম্বর ১৬০৫৫৩০০৬৮৭০৯০৪১। এ ঋণের টাকায় খোলা এ অ্যাকাউন্টে ১৭ কোটি টাকার মার্জিন ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ নিজেকেই নিজে ঋণ দিয়েছে। কারসাজির চক্রের সুবিধায় ব্যবহার হওয়ায় এ অ্যাকাউন্টটিও এখন মূলধনি লোকসানি অ্যাকাউন্টের খাতায়। গত আগস্ট শেষে এ অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসান ছিল আড়াই কোটি টাকা।
মুনাফা দেখাতে বেআইনি লেনদেন
মুনাফা দেখাতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্চেন্ট ব্যাংকটি নিজস্ব পোর্টফোলিও অ্যাকাউন্ট থেকে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ৩০ লাখ শেয়ার ৮১ টাকা দরে বিক্রি করে প্রায় ১৫ কোটি টাকা মুনাফা দেখায়। ক্রেতা মার্চেন্ট ব্যাংকটির নিজস্ব মার্জিন অ্যাকাউন্টটি। আইন অনুযায়ী, মালিকানা বদল না হওয়ায় এটি লেনদেনযোগ্য নয়। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও জানত। তবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
আত্মীয়ের নামে শেয়ার ব্যবসা
গ্রাহক কোড এস১১৩২৫ অ্যাকাউন্টটি রেশমা খাতুনের। ২০২১ সালের অক্টোবরে চালুর পর অ্যাকাউন্টটিতে নগদ জমা ও চেকের মাধ্যমে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এ সময় শেয়ার কেনাবেচায় মুনাফা থেকে ২৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, রেশমা খাতুন মার্চেন্ট ব্যাংকটির সিওও হুমায়ূন কবিরের আত্মীয়। গ্রাহক কোড এস৩০০০৫ হলো আবু সায়েম নামের ব্যক্তির, যিনি সম্পর্কে হুমায়ূন কবিরের ভাগনে। এ অ্যাকাউন্টটি মার্জিন কোড না হওয়ার পরও মার্জিন ঋণ দেওয়া হয়েছে। বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে গত বছর এ অ্যাকাউন্টে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের শেয়ার কিনে প্রায় ১৯ লাখ টাকা এবং এ বছর প্রগতি লাইফের শেয়ার কিনে ২১ লাখ টাকা মুনাফা হয়। সম্প্রতি এ অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে নতুন করে আরেকটি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। ক্যাশ অ্যাকাউন্ট হওয়ার পরও ঋণ দিয়ে প্রগতি লাইফের শেয়ার কেনা হয়েছে। তাতে মুনাফা হয়েছে অন্তত ১৫ লাখ টাকা।
জানা গেছে, কর্মকর্তা রাজীব আহমেদ শেয়ার ব্যবসা করেন নিকটাত্মীয় তাহমিনা বেগম ও রফিকুল কামাল চৌধুরীর মাধ্যমে। তাহমিনার অ্যাকাউন্টে ৯০ লাখ টাকা জমা দিয়ে মুনাফাসহ তুলে নেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। রফিকুল কামাল চৌধুরীর অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ টাকা জমা দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৭৮ লাখ টাকা।
বে লিজিংয়ের কর্মকর্তা মফিজউদ্দিন এ মার্চেন্ট ব্যাংকটিতে বিলকিস বেগম এবং ছেলে ইব্রাহিম খলিলের নামে দুটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ার ব্যবসা করেন। বিলকিস বেগমের অ্যাকাউন্টে সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা জমা করে এখন পর্যন্ত মুনাফাসহ সাড়ে ৮৪ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। ইব্রাহিম খলিলের একটি অ্যাকাউন্টে সোয়া ৬ লাখ টাকা জমা করে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা এবং অন্য অ্যাকাউন্টে সোয়া ১০ লাখ টাকা জমা করে সাড়ে ১৬ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। এর বাইরে বহু অ্যাকাউন্ট কর্মকর্তাদের আত্মীয়দের নামে বলে জানা গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে ইচ্ছামতো মার্জিন ঋণ দেওয়া হয়েছে।
গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে বিশাল অঙ্কের লোকসানের বিপরীতে নিকটাত্মীয়দের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ার কেনাবেচায় বিপুল মুনাফার বিষয়ে জানতে চাইলে মার্চেন্ট ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, তারা কেউ নামে-বেনামে শেয়ার কেনাবেচা করেন না। তবে হুমায়ূন কবির জানান, গ্রাহক বাড়াতে তারা প্রথমে নিজের আত্মীয়কে শেয়ারে বিনিয়োগে অনুরোধ করেন। এমন কিছু অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে, যা বেআইনি নয়।
আত্মপক্ষ সমর্থনে দায়িত্বশীলদের ভাষ্য
জানতে চাইলে সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির বলেন, বাংলামটরের রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারের ফ্লোর স্পেস কেনায় অনিয়ম হয়নি। তিনি বলেন, রূপায়ণে স্পেস যখন কেনা হয়, তখন এর দাম ৬০ হাজার টাকা (প্রতি বর্গফুট) উঠেছিল বলে শুনেছি। রূপায়ণের মালিক মুকুল সাহেব সম্পর্কের কারণে দাম কিছুটা কম রেখেছেন। রূপায়ণই ৪৪ হাজার টাকার বেশি দরে বিক্রির প্রস্তাব করে চিঠি দেয়, যা দরাদরি কমানো হয়।
গ্রাহকের মূলধনি লোকসানি অ্যাকাউন্টের লোকসান এবং কারসাজি চক্রের সহায়তায় ব্যবহার বিষয়ে আলমগীর কবির বলেন, ব্যবস্থাপনা বিভাগ যে তথ্য দিয়েছে, তার বাইরে জানার কিছু ছিল না। যদি কিছু হয়ে থাকে, তার দায় ব্যবস্থাপনা বিভাগের। তবে শুনেছি, এ প্রতিষ্ঠানের রাজীব নামের ছেলেটি বেশ ‘বদমাইশ’। সে কিছু ‘আকাম-কুকাম’ করেছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছে।
তবে পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা রাজীব আহমেদ দাবি করেন, তিনি কোনো অনিয়ম করেননি। মূলধনি লোকসানি অ্যাকাউন্টে কেনাবেচা হয়েছে ইনভেস্টমেন্ট কমিটির পরামর্শে, যেখানে এমডি আবু বকর, সিওও হুমায়ূন কবিরসহ আরও অনেকে আছেন। শেয়ার কারসাজি চক্রের হোতা আবুল খায়ের হিরোর সঙ্গে যোগসাজশে নিজে শেয়ার কেনাবেচার অভিযোগও অস্বীকার করেন।
এদিকে, মূলধনি লোকসানি অ্যাকাউন্টে শেয়ার কেনাবেচা হয়ে থাকলে এর দায় হেড অব কমপ্লায়েন্স অফিসার ইবনে রিয়াজের বলে এমডি আবু বকর এবং সিওও হুয়ায়ূন কবির যে দাবি করেন, সে বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে প্রথমে রিং হলেও রিসিভ করেননি। পরে ফোন বন্ধ করে দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. আল-আমীন বলেন, মূলধনি লোকসানি গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে শেয়ার কারসাজির জন্য ব্যবহার করার অভিযোগ বহু পুরোনো। তদন্ত হলে থলের বেড়াল বের হয়ে আসবে। শুধু সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস নয়, যেসব ব্রোকারেজ হাউস নেগেটিভ ইক্যুয়িটি অ্যাকাউন্ট পুষছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। samakal.com
southeast bank