গত জুলাইয়ের আগে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কিস্তির আগের মতো রেখে বাড়তি সুদ আদায় করতে হবে কিস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে।
গত বছরের জুলাইয়ের আগে যাঁরা গৃহঋণ ও শিল্পের মেয়াদি ঋণ নিয়েছেন, ব্যাংকের সুদহার বাড়লেও তাদের কিস্তির টাকার পরিমাণ বাড়বে না। কিস্তির টাকা না বাড়িয়ে কিস্তির সংখ্যা ও মেয়াদ বাড়িয়ে বাড়তি সুদ আদায় করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ–সংক্রান্ত নির্দেশনা গতকালই দেশের সব ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।
ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের (২০২৩ সাল) জুলাই থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন আবাসনঋণ নেওয়া অনেক গ্রাহক। আবার অর্থনীতির চলমান সংকটের মধ্যে ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় শিল্পের মেয়াদি ঋণগ্রহীতা উদ্যোক্তারা পড়েছেন বাড়তি চাপে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের কিস্তি আগের মতো রেখে বাড়তি সুদ মেয়াদ বাড়িয়ে আদায়ের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ সুবিধা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতাদের নিজ নিজ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। এর পরই ব্যাংক কিস্তির টাকার অঙ্ক না বাড়িয়ে কিস্তির মেয়াদ বাড়ানোর এই সুবিধা দিতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তবে গত বছরজুড়েই দেশে ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। পাশাপাশি ২০২২ সাল থেকে দেখা দেওয়া ডলার–সংকটের কারণে ব্যবসা–বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সংকটা তীব্র হয়। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় গত বছরের জুলাই থেকে ব্যাংকঋণের সুদের বেঁধে দেওয়া সীমা তুলে নেওয়া হয়। গত বছরের জুলাই থেকে ঋণের সুদ নির্ধারণে প্রথমে চালু করা হয় স্মার্ট–পদ্ধতি। পরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের পরামর্শে স্মার্ট–পদ্ধতি বাতিল করে ব্যাংকঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ বর্তমানে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে পুরোনো ঋণগ্রহীতার ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় গ্রাহকদের কিস্তির অঙ্কও বেড়ে যায়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল নতুন নির্দেশনা জারি করেছে।
আমরা ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে শিল্পঋণের কিস্তি না বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছিলাম। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা শিল্পের জন্য ইতিবাচক।
আশরাফ আহমেদ, সভাপতি, ঢাকা চেম্বার
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক বিরূপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্মার্ট ও বাজারভিত্তিক সুদহারের কারণে গত বছরের ১ জুলাইয়ের আগে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিপর্যায়ে গৃহনির্মাণ ঋণগ্রহীতাদের প্রদেয় কিস্তির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে গ্রাহকেরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, কিস্তির টাকার পরিমাণ না বাড়িয়ে কিস্তির সংখ্যা ও মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে। কিস্তির মেয়াদ ও সংখ্যা বাড়ানো হলেও তা ঋণ পুনর্গঠন হিসেবে বিবেচিত হবে না। বেতনভোগী চাকরিজীবীদের বেতনের বিপরীতে গৃহীত ঋণের ক্ষেত্রে গ্রাহকের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সময়সীমার মধ্যে ব্যাংক নিজস্ব বিবেচনায় অর্থ পরিশোধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। চলতি বছরের গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিয়মিত ছিল এমন ঋণ এই সুবিধার আওতায় আসবে। তবে রূপান্তরিত মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এ সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে কোন কোন ঋণ এই সুবিধার আওতায় আসবে, সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার প্রণীত বা গঠিত প্রণোদনা প্যাকেজ বা বিশেষ তহবিলের আওতায় দেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে না। এসব সুবিধা পাওয়ার যোগ্য সব ঋণগ্রহীতাকে এ বিষয়ে অবহিত করতে হবে। কোনো ঋণগ্রহীতা এই সুবিধা নিতে চাইলে লিখিত আবেদন করতে হবে; আবেদন পাওয়া সাপেক্ষে এই সুবিধা দেওয়া যাবে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে শিল্পের মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭২ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। একই সময়ে গ্রাহকেরা আবাসন খাতের জন্য ব্যাংক থেকে ৫৮ হাজার ১০৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে গত বছর শিল্প খাত বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে। ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে সুদের কারণে ঋণের কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক শিল্পোদ্যোক্তা আরও বেশি চাপে পড়েছেন। তাই আমরা ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে শিল্পঋণের কিস্তি না বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছিলাম। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা শিল্পের জন্য ইতিবাচক। এটি এ খাতের জন্য খুবই জরুরি ছিল।’