খেলাপি ঋণ কম দেখাতে ঋণ অবলোপন প্রক্রিয়া সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে দুই বছর মন্দ মানে শ্রেণীকৃত যেকোনো ঋণই অবলোপন করা যাবে। আগে তিন বছর মন্দ মানের খেলাপি থাকার পর তবেই ওই ঋণ অবলোপন করার সুযোগ ছিল। রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারীকৃত এক প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকগুলোর প্রতি নতুন নির্দেশনা দেয়া হয়। ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ’ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনটি দেশের সব ক’টি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
ঋণ অবলোপন হলো খেলাপি হয়ে যাওয়া কোনো ঋণকে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে বাদ দেয়ার সুযোগ। অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন বা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট কিছুটা পরিচ্ছন্ন দেখাতে পেরেছে ব্যাংকগুলো।
অবলোপন-সংক্রান্ত নতুন নীতিমালায় বলা হয়, যেসব ঋণ হিসাব একাদিক্রমে দুই বছর মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকৃত রয়েছে সেগুলো অবলোপন করা যাবে। আবার ঋণের শ্রেণীমান যা-ই হোক না কেন, কোনো মৃত ব্যক্তির নিজ নামে অথবা তার একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত ঋণ হিসাবও ব্যাংক স্বীয় বিবেচনায় অবলোপন করতে পারবে। তবে একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির উপার্জনক্ষম উত্তরসূরি রয়েছে কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে।
ঋণ অবলোপন পদ্ধতির বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অবলোপনযোগ্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের অনুকূলে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি (যদি থাকে) নিয়মানুগভাবে বিক্রির প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলে এবং ব্যাংকে নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায়ে সমর্থ না হলে ওই ঋণ অবলোপনের আওতায় আসবে। অবলোপনের জন্য নির্বাচিত ঋণের ক্ষেত্রে পূর্বে আইনগত ব্যবস্থা সূচিত না হয়ে থাকলে অবলোপনের পূর্বে অবশ্যই অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী মামলা করতে হবে। তবে এর আওতায় অত্যাবশ্যকীয়ভাবে মামলাযোগ্য না হলে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ এবং মৃত ব্যক্তির নিজ নামে অথবা তার একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত যেকোনো অংকের ঋণ মামলা দায়ের ব্যতিরেকে অবলোপন করা যাবে। অবলোপনের আগে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবের স্থিতি হতে শুধু রক্ষিত স্থগিত সুদ বাদ দেয়ার পর অবশিষ্ট ঋণস্থিতির সমপরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে অবলোপনের জন্য চিহ্নিত প্রতিটি ঋণ হিসাবের বিপরীতে রক্ষিত প্রভিশন পর্যাপ্ত না হলে ব্যাংকের চলতি বছরের আয় খাত বিকলন করে অবশিষ্ট প্রভিশন সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ঋণ হিসাব আংশিকভাবে অবলোপন করা যাবে না। পরিচালনা পর্ষদের (বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশী ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তে স্থানীয় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের) অনুমোদন ছাড়া কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে না।
অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ও তদারকির বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ২৮(ক) ধারা অনুযায়ী অবলোপনের পরও সংশ্লিষ্ট ঋণের ওপর ব্যাংকের দাবি বহাল থাকবে। অবলোপন-পরবর্তী সময়ে উক্ত অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে আইনগত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রধান কার্যালয়ে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দুই ধাপ নিচে নন এমন একজন কর্মকর্তাকে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিটের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। উক্ত ইউনিটে ঋণ মঞ্জুরি কার্যক্রম, ঋণের ডকুমেন্টেশন ও ঋণ আদায়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বহাল করতে হবে। তবে ন্যূনতম একজন আইন বিষয়ে ডিগ্রিধারী কর্মকর্তাকে এ ইউনিটে বহালের ব্যবস্থা করতে হবে। যে শাখা বা বিভাগের অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে ওই শাখা বা বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন উপযুক্ত কর্মকর্তাকে আদায় কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগকালে উক্ত পদের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শর্তাবলিতে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়-সংশ্লিষ্ট শর্ত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সক্ষমতা বা বার্ষিক আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তার উক্ত পদে পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্ম উৎকর্ষের অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায় অগ্রগতির বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সভাপতিত্বে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট কর্তৃক মাসিক ভিত্তিতে সভা আয়োজন করতে হবে। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত কার্যবিবরণী আকারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায় সম্পর্কিত অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রতি ত্রৈমাসিকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করতে হবে। ব্যাংকের পাওনা আদায়ে দায়েরকৃত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দক্ষ ও খেলাপি ঋণ আদায়-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনায় অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগসহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যাংকের আইন বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাসহ লিগ্যাল রিটেইনারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করবেন।
প্রজ্ঞাপন জারির ১৫ দিনের মধ্যে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। ইউনিট গঠনের পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা উক্ত ইউনিটে বহাল করতে হবে। অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে আদায়কৃত অর্থের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ প্রণোদনা হিসেবে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণযোগ্য হবে। বিতরণযোগ্য অর্থের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রাপ্য হবেন। অবশিষ্ট অর্থ অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিটের প্রধানসহ উক্ত ইউনিটের অন্যান্য কর্মকর্তা প্রাপ্য হবেন।
source: defaulted loan bangladesh bank bb