শেয়ারবাজারের ৩৫টি কোম্পানি ছাড়া বাকি সব শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তর গত বৃহস্পতিবার তুলে নেওয়া হয়েছে। ফ্লোর প্রাইস আরোপের প্রায় দেড় বছর পর এসে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে এক আদেশে তা তুলে দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। যা ২১ জানুয়ারি রোববার থেকে কার্যকর হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির আদেশে বলা হয়েছে, সরকারের নির্দেশনা মেনে বিএসইসি বিনিয়োগকারী ও শেয়ারবাজারের স্বার্থে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত ৩৫টি কোম্পানির শেয়ারের ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল থাকবে। যেসব কোম্পানির ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সার্কিট ব্রেকার তথা এক দিনে মূল্যবৃদ্ধি বা কমার সীমা আরোপ থাকবে। সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন সীমা পৌনে ৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। অর্থাৎ এক দিনে এসব কোম্পানির দাম সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে বা বাড়তে পারবে। শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালুর আগে থেকেই সার্কিট ব্রেকারের এ সীমা চালু রয়েছে।
৩৫ কোম্পানিতে ফ্লোর প্রাইস বহাল : বিএসইসি যে ৩৫টি কোম্পানির ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রেখেছে, সেগুলো হচ্ছে আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, বারাকা পাওয়ার, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো লিমিটেড, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল, বিএসআরএম লিমিটেড, বিএসআরএম স্টিল, কনফিডেন্স সিমেন্ট, ডিবিএইচ, ডরিন পাওয়ার, এনভয় টেক্সটাইল, গ্রামীণফোন, এইচআর টেক্সটাইল, আইডিএলসি, ইনডেক্স অ্যাগ্রো, ইসলামী ব্যাংক, কেডিএস এক্সেসরিজ, খুলনা পাওয়ার, কাট্টলি টেক্সটাইল, মালেক স্পিনিং, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, ন্যাশনাল হাউজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল পলিমার, ওরিয়ন ফার্মা, পদ্মা অয়েল, রেনেটা, রবি আজিয়াটা, সায়হাম কটন, শাশা ডেনিমস, সোনালী পেপার, সোনার বাংলা ইনস্যুরেন্স, শাইনপুকুর সিরামিকস, শাহজিবাজার পাওয়ার, সামিট পাওয়ার ও ইউনাইটেড পাওয়ার।
বিএসইসির আদেশে ৩৫টি কোম্পানির ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখার কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ডিএসইএক্স সূচকে অন্তর্ভুক্ত যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে এবং যাদের শেয়ারের দামের উত্থান-পতন সূচকের ওপর প্রভাব ফেলে, মূলত সেগুলোর ওপরই ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা হয়েছে। এর বাইরে অবশ্য কয়েকটি কোম্পানিকে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়া দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে এ তালিকায় রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বাজারে পতন ঠেকাতে বিনিয়োগকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক সময়ের জন্য ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়েছিল। এরপর নানা বাস্তব কারণে ফ্লোর প্রাইসের সময় দীর্ঘায়িত হয়। এখন বাজারসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকি ৩৫টির ফ্লোর প্রাইসও পরে তুলে নেওয়া হবে। আশা করছি, বাজারে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়বে। তাতে বাজার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে। এভাবে আমরা একটা গতিশীল বাজার দেখতে পাব।’
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, যেসব কোম্পানির লেনদেনযোগ্য তথা ফ্রি ফ্লোট শেয়ার এবং বাজার মূলধন বেশি, সেগুলোর ওপরই মূলত ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা হয়েছে। ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ায় বাজারে সূচকের যাতে বড় ধরনের পতন না হয়, সে জন্য এ কৌশল নেওয়া হয়েছে। ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার এ সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকরের কথা বলা হলেও বাজারে এর প্রভাব দেখা যাবে আগামী রোববার থেকে। ওই দিন থেকে শেয়ারবাজারে নতুন সপ্তাহের লেনদেন শুরু হবে। আজ শুক্র ও কাল শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে লেনদেন বন্ধ থাকবে। রোববার থেকে যদি দেখা যায়, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ায় বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না, তাহলে বাকি ৩৫টির ফ্লোর প্রাইসও তুলে নেওয়া হবে।
শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই সর্বশেষ দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিল বিএসইসি। ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর একটি বড় অংশের শেয়ারের দাম কমে ফ্লোর প্রাইসে আটকে যায়।
এতে গত প্রায় দেড় বছর ধরে এসব কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন হচ্ছে না বললেই চলে। ফলে পুঁজিবাজারেও একধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। এ অবস্থায় বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল।
এদিকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর বাজারে যাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল থেকে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাজারে বিনিয়োগের জন্য কম সুদে ১০০ কোটি টাকার তহবিল সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে এ সহায়তা আরও বাড়ানো হবে বলে বিএসইসি সূত্রে জানা যায়।
অংশীজনেরা যা বলছে :
দেড় বছর পর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তে সাময়িকভাবে হয়তো বাজারে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে; তারপরও আমি মনে করি, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার কারণে বাজার তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে। বাজার স্বাভাবিক ধারায় ফেরা মানে শুধু দাম বাড়বে, তা নয়। বাজারে বিনিয়োগকারীরা কেনাবেচার সুযোগ পাবেন, এটাই বাজারের স্বাভাবিক ধারা। এর মাধ্যমে শেয়ারের দাম ওঠানামা করবে। যেসব কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস এখনো তোলা হয়নি, আমি আশা করি সেগুলোর বিষয়েও নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেবে।’
বিএসইসির সিদ্ধান্তের বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার এই সিদ্ধান্তে দীর্ঘ সময় পর বাজার তার নিজস্ব গতিতে ফেরার সুযোগ পাবে। অনেক বিনিয়োগকারীর কেনা শেয়ার দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল। তাই শুরুতে হয়তো বাজার কিছুটা ধাক্কা খাবে। কিন্তু স্বাভাবিক লেনদেনের সুযোগ অব্যাহত থাকলে শেয়ারের দাম তার নিজস্ব শক্তিতেই ঘুরে দাঁড়াবে। তবে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের এই বার্তাও দিতে হবে, এ ব্যবস্থা আর ফিরে আসবে না। তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ দীর্ঘ মেয়াদে যাঁরা বিনিয়োগ করেন, তাঁদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।
এদিকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার আগে গতকাল দুপুরে রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই মিলনায়তনে ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সঙ্গে পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরামের (সিএমজেএফ) এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলোচনায়ও ঘুরেফিরে ফ্লোর প্রাইসের প্রসঙ্গটি আসে। ডিবিএর নবনির্বাচিত সভাপতি সাইফুল ইসলাম মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারের যে সংজ্ঞা, ফ্লোর প্রাইসের কারণে আমরা সেখান থেকে সরে গেছি। ফ্লোর প্রাইসের কারণে ৮০ শতাংশ ব্রোকারেজ হাউসের এখন পরিচালন খরচই উঠছে না। যে কারণে বেশির ভাগ ব্রোকারেজ হাউস এখন দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি স্টক এক্সচেঞ্জও আর্থিকভাবে রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সামনে এখন টিকে থাকাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।’
একই অনুষ্ঠানে ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান বলেন, ডিএসই এখন এক ঠুঁটো জগন্নাথ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একসময় নতুন আইপিও বাজারে আসা ও খারাপ কোম্পানিকে বাজার থেকে তালিকাচ্যুত করাসহ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল স্টক এক্সচেঞ্জের। এখন কাগজে–কলমে অনেক কিছু থাকলেও বাস্তবে স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ারবাজারের বিষয়ে নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই শেয়ারবাজারে সক্ষমতা বাড়াতে হলে স্টক এক্সচেঞ্জকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
ব্রোকারহাউজ প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন সিইও ফোরামের বৈঠক
পুঁজিবাজারের শীর্ষ ব্রোকারহাউজগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন সিইও ফোরাম রোববার (২১ জানুয়ারি) বৈঠক ডেকেছে। বৈঠকে সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি, বিশেষ করে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের উপর থেকে ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিইও ফোরামের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহারের কারণে যাতে বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সে ব্যাপারে করণীয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা। তারা খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চান, থাকতে চান বাজার ও বিনিয়োগকারীদের পাশে।
তারা বলেছেন, ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহার হলেও উদ্বেগের কিছু নেই। দেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। সামষ্টিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে চাপমুক্ত হচ্ছে। বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম অনেকটা যৌক্তিক পর্যায়ে আছে। তাই বাজার নিয়ে উদ্বেগের তেমন কিছু নেই। শুধু ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহারের কারণে যাতে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত না হন, বাজারে বিক্রির চাপ তৈরি না হয় সে লক্ষ্যে বিনিয়োগকারীদের কথা বলবেন। পাশাপাশি নিজেরা বিনিয়োগে থাকার চেষ্টা করবেন।
গত বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫ কোম্পানি ব্যাতিত বাকী সব কোম্পানির উপর থেকে ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত রোববার কার্যকর হবে। আলোচিত কোম্পানিগুলোর শেয়ারে কাল থেকে স্বাভাবিক সার্কিটব্রেকার কার্যকর থাকবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং শ্রীলংকার দেউলিয়া ঘোষণাজনিত আতঙ্কের প্রেক্ষিতে দেশের পুঁজিবাজারে বড় দর পতনের আশংকার প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে বিএসইসি। তার আগে কোভিড-১৯ এর প্রকোপ শুরু হওয়ার পর একবার ফ্লোরপ্রাইস আরোপ করা হয়েছিল।
ফ্লোরপ্রাইস আরোপের ফলে বাজারে লেনদেন ব্যাপকভাবে কমে যায়। এতে ব্রোকারহাউজসহ সব স্টেকহোল্ডার ক্ষতির মুখে পড়ে। অনেক বিনিয়োগকারীও সমস্যায় পড়েন, অতি জরুরি প্রয়োজনেও তারা বাজার থেকে টাকা প্রত্যাহার করতে পারছিলেন না।
দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোরপ্রাইস বহাল থাকায় বাজার একরকম মুখ থুবড়ে পড়ে। এ কারণে তা প্রত্যাহারের দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছিল। এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিএসইসি ৩৫ কোম্পানি ছাড়া বাকী কোম্পানিগুলোর উপর থেকে ফ্লোরপ্রাইস তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
source: sharebusiness24.com
floor price after reaction in stock market porer obostha bangladesh