বৈদেশিক বাণিজ্য ও রেমিট্যান্স আহরণে ভূমিকা রাখার শর্তে ২০১৩ সালে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে লাইসেন্স পায় বেসরকারি খাতের এনআরবি ব্যাংক। তবে এক দশক পার হলেও ওই দুটি ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। উল্টো নানা কারসাজির মাধ্যমে ব্যাংকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে একটি পরিবার। চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান ও তার পরিবার ব্যাংকের মোট শেয়ারের এক-চতুর্থাংশ দখলে নিয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও আইন অনুযায়ী, একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে কোনো ব্যাংকের মোট শেয়ারের ১০ শতাংশের বেশি থাকার সুযোগ নেই। তবে সেই নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এনআরবি ব্যাংককে কুক্ষিগত করেছেন মাহতাবুর রহমান। ছেলে, ছেলের বউ, ভাতিজা এবং ভাতিজা বউয়ের নামে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন। আবার উপহারের নামে নিজেদের মধ্যেই বিনিময় করেছেন সেসব শেয়ার। শুধু মালিকানা নিয়ন্ত্রণ নয়, ব্যাংকটির সার্বিক কর্মকাণ্ডেও এই পরিবারের যথেচ্ছাচার চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি সময়ের মধ্যে এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান ও তার ছেলে ইমদাদুর রহমান রেমিট্যান্স হিসেবে মাহতাবুরের ভাতিজা আশফাকুর রহমানের এনআরবি ব্যাংকের ১০১২০৩০০৪৩৪৫৬ নম্বর হিসাবে মোট ৭ লাখ ৮১ হাজার ৬৩০ ডলার পাঠান। একই সময়ে আশফাকুর রহমান নিজে দুবাই থেকে রেমিট্যান্স হিসেবে ৪ লাখ ৭১ হাজার ৮৬১ মার্কিন ডলার দেশে পাঠান। এই অর্থ দিয়ে আশফাকের নামে এনআরবি ব্যাংকের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার ইঞ্জিনিয়ার মো. একরামুল হকের কাছ থেকে ৯০ লাখ শেয়ার ক্রয় করা হয়। সেই সময় ওই শেয়ারের বাজার মূল্য ছিল ১০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বা ১২ লাখ ৫৩ হাজার ডলার (প্রতি ডলার ৮২ টাকা ৯০ পয়সা হিসাবে)। ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ব্যাংকের ৬১তম বোর্ড সভায় এসব শেয়ারের হস্তান্তর অনুমোদন করা হয়। বর্তমানে আশফাকুর এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক। এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান ও তার ছেলের পাঠানো অর্থ দিয়ে প্রায় ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার শেয়ার কেনা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চেয়ারম্যান ও তার ছেলেই বেনামে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শুধু আশফাকুর নন, এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান তার আরেক ভাতিজা এহসানুর রহমানকে দিয়েও বেনামে ২৯ লাখ ১৬ হাজার শেয়ার কিনিয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ৮৬তম বোর্ড সভার অনুমোদনে স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার ডক্টর উদ্দিন আহমেদ আফসারের কাছ থেকে ৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকায় ২৯ লাখ ১৬ হাজার শেয়ার ক্রয় করেন এহসানুর। এই অর্থ পরিশোধে একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর মাহতাবুর তার ভাতিজা এহসানুরের এনআরবি ব্যাংকের হিসাবে (নম্বর ৩০১২০৩০০৯০২৫৩) ২ লাখ ৫১ হাজার ৪৬৭ ব্রিটিশ পাউন্ড পাঠিয়েছেন। একই দিনে এহসানুর তার ব্যাংক হিসাব থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড ডক্টর উদ্দিন আহমেদ আফসার এনআরবি ব্যাংকের হিসাবে (নম্বর ১০১২০৩০০৫১১৪৮) স্থানান্তর করেন। পরে তিনি ওই অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। ওই সময় ব্রিটিশ পাউন্ডের বাজার মূল্য ছিল ১০০ টাকা। সেক্ষেত্রে মাহতাবুরের পাঠানো অর্থ দিয়ে প্রায় ১৫ লাখ ৭২ হাজার শেয়ার ক্রয় করা হয়েছে। ব্যাংকটি বাকি অর্থের লেনদেনের হিসাব বিবরণী সরবরাহ না করায় অবশিষ্ট শেয়ার অর্থাৎ ১৩ লাখ ৪৪ হাজার শেয়ারের মূল্য কোন উৎস থেকে পরিশোধ করা হয়েছে, তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এর ১৪ক(১) ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো ব্যক্তি কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাইবে না এবং কোনো ব্যক্তি কোম্পানি বা কোনো পরিবারের (পরিবারের অর্থে কোনো ব্যক্তির স্ত্রী, স্বামী, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাইবোন এবং ওই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সকলকে বুঝাইবে) সদস্যগণ একক, যৌথ বা উভয়ভাবে কোনো ব্যাংকের শতকরা ১০ ভাগের বেশি শেয়ার ক্রয় করিবেন না।’
এনআরবি ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকটির মোট শেয়ারের পরিমাণ ৫৯ কোটি ৫ লাখ ৮৬ হাজার। এর মধ্যে ব্যাংকে চেয়ারম্যানের পরিবারের মোট শেয়ার ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৬৯ হাজার, যা ব্যাংকের মোট ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর বাইরে চেয়ারম্যানের ভাতিজা ও পুত্রবধূদের নামে উপহার হিসেবে ২ কোটি ৩৯ লাখ শেয়ার স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ ওই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০১৩ সালে সংশোধিত)-এর ১৪ক(১) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
শুধু তাই নয়, আশফাকুর রহমানের ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার ও এহসানুর রহমানের ১৫ লাখ ৭২ হাজার শেয়ার কেনা হয়েছে চেয়ারম্যান ও তার ছেলের পাঠানো টাকায়। এসব শেয়ারকে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিবেচনা করলে পরিবারটির নিয়ন্ত্রণে থাকা শেয়ারে পরিমাণ দাঁড়াবে ৮ কোটি ৮৭ লাখ ৮৯ হাজার, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। মাহতাবুর রহমানকে তার পুত্রবধূ ও ভাতিজা বউদের নামে কেনা শেয়ারের অর্থ জোগানদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিলে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা শেয়ার সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ কোটি ৪২ লাখ ৫৮ হাজার বা মোট শেয়ারের ২৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এর ১৪ ক (২) ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো ব্যাংক কোম্পানি কর্তৃক যাচিত উক্ত ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ের সময় ক্রেতা এ মর্মে শপথপত্র বা ঘোষণাপত্র দাখিল করিবেন যে, তিনি অন্যের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে বা বেনামিতে শেয়ার ক্রয় করিতেছেন না এবং ইতোপূর্বে বেনামিতে কোনো শেয়ার ক্রয় করেন নাই।’
অথচ এনআরবি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো শেয়ার ধারণ-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান বেনামে শেয়ার কেনার মাধ্যমে আইনের ওই ধারা লঙ্ঘন করেছেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমানের সঙ্গে নানা মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এনআরবি ব্যাংক অন্য কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালকদের ৭২৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত খেলাপি না হলেও এ ধরনের ঋণ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য ভালো ব্যাংকগুলোতেও ধীরে ধীরে অনিয়মের পরিমাণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্ত অবস্থানে না গেলে ব্যাংক খাত ধসে পড়বে বলেও আশঙ্কা তাদের।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ব্যাংকের পরিচালকরা সাধারণত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বেনামে বা অন্য কাউকে দিয়ে বেশি শেয়ার ক্রয় করান। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হচ্ছে সেগুলো তদন্ত করে বের করা এবং দোষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। ব্যাংক কোম্পানি আইনে এ ধরনের অনিয়মের শাস্তির বিধান সুনির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু যারা এ ধরনেরর কাজ করেন তারা অতি প্রভাবশালী হওয়ায় অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমস্যায় পড়ে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতার কারণেই এসব তথ্য তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এখন প্রয়োজন ব্যক্তির প্রভাব না দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান প্রয়োগ করা।’
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা প্রভাব খাটিয়ে অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ দেন। আগে নিজের ব্যাংক থেকেই পরিচালকরা বেশি ঋণ নিতেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী এখন পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে তাদের মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারছেন না। তবে তাদের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে কোনো বাধা নেই। ফলে তারা এখন পরস্পরের যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে যেমন ঋণ নিচ্ছেন, তেমনি প্রভাব খাটিয়ে নানা সুবিধাও নিচ্ছেন।’
এদিকে বিদেশি বাণিজ্য ও রেমিট্যান্সে বড় ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এনআরবি ব্যাংক লাইসেন্স নিলেও এসব ক্ষেত্রে তেমন ভূমিকা পালন করতে পারেনি ব্যাংকটি। চলতি অর্থবছরের নভেম্বরে দেশে মোট ১৯৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। আর এর মধ্যে মাত্র ২ কোটি ৬৮ লাখ ডলার এসেছে এনআরবি ব্যাংকের মাধ্যমে। অর্থাৎ রেমিট্যান্সের মাত্র ১ শতাংশ এসেছে এই ব্যাংকে। খেলাপি ঋণও বাড়ছে ব্যাংকটির। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি ৫ হাজার ৬৭৬ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৩৪৭ টাকা। আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ২৭৪ কোটি টাকা।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে প্রশ্ন পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি।
পরে ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা নুরুল আফসার জহিরকে ফোন করা হলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
source: kalbela.com
Mahtabur share karsaji remittance