শেয়ারবাজারে শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজ আভিভা ইক্যুইটিতে ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে। সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে (সিসিএ) ঘাটতি, নেগেটিভ অ্যাকাউন্টে ঋণ প্রদান, ডিলার অ্যাকাউন্ট ও নেগেটিভ অ্যাকাউন্টে শেয়ার ডাম্পিং, অতিরিক্ত দামে প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্রয়, সীমাহীন শেয়ার কারসাজি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শহিদুল ইসলামের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। পরিদর্শক দলের কাছে ঘটনার দায় স্বীকার করছেন শহিদুল ইসলাম। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে, প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ডিএসইর প্রতিবেদন পেলে অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখব। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। অনিয়ম ও কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে কমিশন। তিনি আরও বলেন, এর আগেও কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। হাউজগুলোর কারসাজি চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে কমিশন। এরপর পরবর্তী সময়ে কারসাজি রোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন চলমান। তার মতে, কেউ আইন লঙ্ঘন করে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে বক্তব্য নিতে আভিভা সিকিউরিটিজের এমডি মো. শহিদুল ইসলামকে কয়েকবার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এরপর যুগান্তরের পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হলে তিন দিনেও সাড়া দেননি তিনি। ডিএসইর ৬২নং ট্রেকহোল্ডার কোম্পানি আভিভা ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সম্প্রতি পরিদর্শন প্রতিবেদন পাঠায় ডিএসই। এছাড়া আভিভা ইক্যুইটির মূল কোম্পানি আভিভা ফাইন্যান্সের চিঠি, অবৈধভাবে আয় বাড়িয়ে দেখানো কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন এবং ডিএসইর পরিদর্শন প্রতিবেদন যুগান্তরের হাতে এসেছে। প্রতিবেদনে কোম্পানির এমডি মো. শহিদুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততায় সীমাহীন অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি ছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি-এমন কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কিনে কোম্পানির অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন মো. শহিদুল ইসলাম। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভুল তথ্য দিয়ে আইন অমান্য করে নেগেটিভ ইক্যুইটি অ্যাকাউন্টে দেওয়া ঋণের ওপর সুদ ধার্য করে আর্থিক প্রতিবেদনে আয় বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। এছাড়া বোর্ড মিটিং ও বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) নামে অর্থ লুটপাটের মাধ্যমে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছেন। গত ২০ জুলাই কোম্পানিটিতে পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করলে এসব অনিয়ম এবং বেআইনি কার্যক্রম বেরিয়ে আসে। কিন্তু কোম্পানি সব সময় ডিএসইকে যে তথ্য দিয়েছে, তাতে সবকিছু সঠিক দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওইসব তথ্য সঠিক ছিল না। ডিএসইর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ১৮ জুন সিকিউরিটিজ হাউজটির সিসিএতে ঘাটতি ছিল ৩ কোটি ৬ লাখ টাকা। ২৫ মে ঘাটতি ছিল ৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। কিন্তু সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে সিসিএতে কোনো ঘাটতি বেআইনি।
সিসিএতে ঘাটতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০২২ সালের ২২ মার্চ বিএসইসি এক নির্দেশনা জারি করে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, গ্রাহক অ্যাকাউন্টে ঘাটতি থাকা কোম্পানিগুলোর ফ্রি লিমিট বন্ধ থাকবে। এছাড়া আরও কিছু শাস্তির কথা বলা হয় নির্দেশনায়। এর মধ্যে রয়েছে-স্টক-ব্রোকার, স্টক-ডিলার এবং ডিপোজিটরি পার্টিসিপেন্টের লাইসেন্স নবায়ন না করা, নতুন শাখা ও বুথ খোলার অনুমতি বন্ধ এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিতরণ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফলে সিসিএ হিসাবে ঘাটতির মাধ্যমে কোম্পানিটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ রুলস, ২০২০-এর রুল ৬(১) ও ৬(৫) এবং সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (স্টক-ডিলার, স্টক-ব্রোকার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালা, ২০০০-এর বিধি ১১ এবং বিধিমালার দ্বিতীয় তফশিলের আচরণবিধি ১ লঙ্ঘন করেছেন।
এদিকে সিসিএতে ঘাটতি ধরা পড়ায় আভিভা ইক্যুইটি তড়িঘড়ি করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একটি ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে ৫ কোটি টাকা সিসিএ হিসাবে জমা দিয়ে বাকি ৫ কোটি টাকা রাখা হয় কোম্পানির হিসাবে। ডিএসই বিষয়টি বুঝতে পেরে ঋণের অনুমোদনপত্র এবং আভিভা ইক্যুইটির বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের কপি চেয়ে চিঠি দেয়। তবে প্রথমদিকে কোনো কাগজপত্র দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। আর এভাবে স্টক এক্সচেঞ্জকে তথ্য না দেওয়া আইনের লঙ্ঘন। এরপর দ্বিতীয় দফা উদ্যোগ নিয়ে ব্রোকারেজ হাউজটি থেকে কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করে ডিএসই। কিন্তু কাগজপত্রে আসল তথ্য লুকানো হয়। এক্ষেত্রে গত ২৫ মে স্টক এক্সচেঞ্জের সিসিএ মডিউলে দেওয়া তথ্যে পেঅ্যাবল (গ্রাহক পাবে) দেখানো হয় ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ১৮ জুন দেখানো হয় ৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। কিন্তু তদন্তকালে ডিএসইর পরিদর্শক দল ২৫ মে প্রকৃত পেঅ্যাবল পেয়েছে ৯ কোটি ২৪ লাখ এবং ১৮ জুন ৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আবার ২০ জুলাই ডিএসইর পরিদর্শক দল প্রতিষ্ঠানটির জমা দেওয়া তথ্য এবং বাস্তবে বিশাল ফারাক খুঁজে পায়। এ ধরনের তথ্য গোপন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অধ্যাদেশ, ১৯৬৯-র ১৮ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ডিএসইর প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, কোম্পানির অনিয়ম ঢাকার জন্য নেগেটিভ ইক্যুইটি হিসাবকে পজিটিভ এবং পজিটিভ অ্যাকাউন্টকে নেগেটিভ হিসাবে দেখিয়েছে।
নিয়ম অনুসারে নেগেটিভ ইক্যুইটি অ্যাকাউন্টে ঋণ দেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু আইন অমান্য এবং পরিচালনা পর্ষদের ছাড়া ৪০ কোটি ২৪ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছেন এমডি শহিদুল ইসলাম। পরিদর্শক দলকে এই টাকার উৎস দেখাতে পারেননি তিনি। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদের ২০২০ সালের সভার সিদ্ধান্ত অমান্য করে এই ঋণের বিপরীতে ৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকা সুদ ধার্য করে আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানির আয় বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। মজার বিষয় হচ্ছে, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন আয়ের বিপরীতে সরকারের কোষাগারে করও জমা দিয়েছেন তিনি। এতে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা আরও দুর্বল হয়েছে। এ ধরনের কাজ মার্জিন রুলস, ১৯৯৯-এর ৫ ও ৬ ধারায় অপরাধ। কারণ ওই ধারায় উল্লেখ আছে নেভেটিভ ইক্যুইটি অ্যাকাউন্টে ঋণ দেওয়া নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে কোম্পানিটিকে শুনানিতে ডাকে ডিএসই। শুনানিতে কোম্পানির হিসাব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ গোলাম সরওয়ার এ বিষয়ে এমডিকে দায়ী করে লিখিত দিয়েছেন। এরপর গত ৩ ডিসেম্বর ডিএসইর পক্ষকে এমডি শহিদুল ইসলাম চিঠি দিয়ে কোম্পানিতে টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত টাকা ফেরত দেওয়ার তথ্য মেলেনি।
এদিকে একটি নেগেটিভ ইক্যুইটির পোর্টফোলিওতে ২১ কোটির টাকার বেশি ঋণ সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। শহিদুল ইসলাম তা না করে সীমাহীন কারসাজির মাধ্যমে বেশি দামে শেয়ার কিনে কম দামে বিক্রি করেন। এতে হিসাবটি পুনরায় নেগেটিভ ইক্যুইটিতে পরিণত হয়। এতে কোম্পানি এবং গ্রাহক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হন। অন্যদিকে ব্রোকারেজ হাউজটির মূল কোম্পানি আভিভা ফাইন্যান্স থেকে গত বছরের ১ আগস্ট দেওয়া এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয় করোনাকালে ৩ কোম্পানির শেয়ার থেকে ১৬৬ কোটি ২১ লাখ টাকা ক্ষতি করেছেন শহিদুল ইসলাম। এছাড়া সুলতান মাহমুদ নামে একজন বিনিয়োগকারীর নামে একটি বিও অ্যাকাউন্ট খোলেন এমডি শহিদুল ইসলাম। যার ক্লায়েন্ট কোড নম্বর ডি১১৮৬। গ্রাহকের অনুমতি ছাড়াই সেখানে কয়েক বছর শেয়ার লেনদেন করেছেন। নেগেটিভ ইক্যুইটি হওয়া সত্ত্বেও কোডে প্রায় ৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। এরপর কোডটি থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করা হয়েছে। ডিএসইর শুনানিতে সুলতান মাহমুদ জানান, শুরু থেকেই ব্রোকারেজ হাউসের এমডি শহিদুল ইসলাম এখানে লেনদেন করেছেন। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। এছাড়া পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ধোঁকা দিয়েছেন তিনি। ডিএসইর শুনানিতে কোম্পানি সেক্রেটারি আরিফ আব্দুত তোয়াব বলেন, সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি কোনো বিষয় নয়। কারণ প্রায় সব কোম্পানিরই সিসিএতে ঘাটতি থাকে। অনুমোদিত প্রতিনিধি শারমিন আরা লিখিতভাবে স্বীকার করেছেন যে, এমডির নির্দেশে তিনি নেগেটিভ ইক্যুইটি অ্যাকাউন্টে লেনদেন করেছেন।
source: jugantor.com
aviva equity management ltd irregularity law break