ডেল্টা লাইফের ২৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ * ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, এমডিসহ অনেকেই জড়িত
পূবালী ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে শক্তিশালী একটি দুষ্টচক্র এই অপকর্মে জড়িত বলে অভিযোগ পেয়েছে সংস্থাটি। ডেল্টা লাইফের ২৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ একই চক্রের বিরুদ্ধে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির ডেটাবেজ সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগও আছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যাংকের অন্তত পাঁচ পরিচালকের সমন্বয়ে গড়া চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে নানা কায়দায় লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে। চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু-একদিনের মধ্যেই তলবি নোটিশ পাঠানো হবে। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে ব্যাংকটির দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে পৃথক তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির একজন যুগ্মপরিচালকের নেতৃত্বে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, ডলার কারসাজি, অর্থ পাচার, নিয়োগে অনিয়ম, বিভিন্ন বন্ধকি সম্পত্তি স্বল্পদামে বিক্রিসহ বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখছে তারা। তবে চক্রটি অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দুদক ও বিএফআইইউ-এর অনুসন্ধান ও তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দুদক থেকে প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বরে জনৈক ফরহাদ হোসেন পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহম্মদ আলী চক্রের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। সেখানে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক ও অপর পরিচালক খবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয় কমিশন। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এর সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক মো. আখতার হোসেন বলেন, অভিযোগ জমার পর তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানকাজ শুরু হয়েছে। বিধি মোতাবেক অনুসন্ধান কর্মকর্তা অভিযোগসংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, পূবালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকটিতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় একটি শক্তিশালী চক্র ব্যাপক অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্য, ভয়াবহ ধরনের ডলার কারসাজি, সম্পত্তি বিক্রি, ঋণ বিতরণে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় বাণিজ্যের আড়ালে রহস্যজনক অর্থ লেনদেন হচ্ছে। এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত ইতঃপূর্বে ক্ষমতার দাপটে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে-পূবালী ব্যাংকের দুষ্টচক্রের অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ আলী। যিনি দীর্ঘদিন ব্যাংকটিতে এমডি ও সিইও পদে আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান এবং এস কে সুরের সহযোগিতায় চক্রের সদস্যরা ব্যাংকটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেন। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির একটি চক্র ডলার কারসাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ লুট করে নেয়। বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে ডলার কিনে ২১১ কোটি টাকা বেশি ব্যয় বা আত্মসাৎ করেছে। মঞ্জুরুর রহমান ও মোহাম্মদ আলী চক্র কিছুদিন আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের এক্সচেঞ্জ করা শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে না দিয়ে বিদেশে পাচার করে। সম্প্রতি বিমানবন্দরে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের অভিযানেও এই অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
দুদকের কাছে তথ্য আছে, ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ২৫ লাখ গ্রাহকের আমানতের ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পূবালী ব্যাংকের অন্যতম অংশীদার ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স। মঞ্জুর রহমান ডেল্টা লাইফে তার চার সন্তানকে পরিচালক পদে নিয়োগ করেছেন। মঞ্জুরের কন্যা আদিবা রহমানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ দিয়েছেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে পূবালী ব্যাংকেও লুটপাট অব্যাহত রাখেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স পূবালী ব্যাংকের শেয়ারধারী হিসাবে পরিচালক হয়েছিলেন মঞ্জুর রহমান। ডেল্টা লাইফের ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ডেটাবেজ সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগ রয়েছে মঞ্জুরুর রহমানের বিরুদ্ধে। এসব তথ্য সম্পর্কে জানতে সংশ্লিষ্টদের দুদকে তলব করা হবে। দালিলিক প্রমাণপত্র সংগ্রহের কাজও চলছে।
এছাড়া পূবালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও বিশদ অভিযোগ রয়েছে দুদকের হাতে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়ম-জালিয়াতির দায়ে ১০ পরিচালককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মঞ্জুরুর রহমানের আগে প্রায় এক যুগ পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ আঁকড়ে ছিলেন হাফিজ। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার জোরে ব্যাংক কোম্পানি আইন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে কয়েকজন দীর্ঘদিন পরিচালক পদে আছেন। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর পর ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ-সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদারও আত্মগোপনে চলে যান। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ও এম খাবিরুজ্জামান ইয়াকুবসহ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটে জড়িত বলে দুদকে জমা নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে আরও বলা হয়, সাবেক সংসদ-সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান। তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মঞ্জরুর রহমান। তারা দুজনই প্রায় দেড় যুগ ধরে পূবালী ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানের পদ দখল করে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন। সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ-সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার আত্মগোপনে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পূবালী ব্যাংকের তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান। তদন্তের আগে আর কিছু বলতে পারব না।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। স্বার্থান্বেসী একটি মহল আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে হয়রানির অপচেষ্টা করছে। আমাদের ব্যাংক সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে পরিচালিত হয়। কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে আমরা জড়িত নই। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত তদন্তে আমাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো অনিয়ম পায়নি।’ দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনুসন্ধান কমিটি গঠনের কথা আমরা জেনেছি। তবে তারা আমাদের কাছে এখনো কোনো তথ্য চায়নি। তারা আমাদের কাছে কোনো তথ্য চাইলে অবশ্যই তা সরবরাহ করা হবে।’ বক্তব্যের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও ব্যাংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।https://www.jugantor.com/tp-lastpage/913269
dudok bangladesh Pubali bank