অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নাম ভাঙিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. তারিকুজ্জামানকে পদত্যাগে চাপ দেওয়া হয়েছে। আর এ কাজ করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব, যিনি ওই মন্ত্রণালয়ের শেয়ারবাজার বিভাগের প্রধান ড. নাহিদ হোসেন। সোমবার বিকালে ফোন করে তিনি ড. তারিকুজ্জামানকে পদত্যাগ করতে বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ড. সালেহউদ্দিন তাকে দ্রুত ইমেইলে পদত্যাগপত্র পাঠাতে বলেছেন। ড. তারিকুজ্জামানও বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন। কিন্তু অর্থ উপদেষ্টার দপ্তর সূত্র যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে, এ ধরনের কথা তিনি বলেননি। অতিরিক্ত সচিবের এ ধরনের কাণ্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও কমিশনার তারিকুজ্জামানের পদত্যাগ চেয়ে অর্থ উপদেষ্টার কাছে শিক্ষার্থীদের নাম করে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে কারও স্বাক্ষর নেই।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে তা গর্হিত কাজ। উপদেষ্টাকে না জানিয়ে, তার নাম ভাঙিয়ে যে কর্মকর্তা এ কাজ করেছেন, ঘটনা তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ড. নাহিদ হোসেন।
জানা যায়, বিএসইসিতে কমিশনারদের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে দুটি গ্রুপ। এই প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত সদ্যবিদায়ি চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির সাবেক ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তার সহযোগী ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক ড. শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ। তারা দুজনই আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের সদস্য। কিন্তু কমিশনার ড. এটিএম তারিকুজ্জামান ছিলেন শিবলী রুবাইয়াতবিরোধী। চলতি বছরের মে মাসে অর্থাৎ সরকার পতনের দুই মাস আগে নিয়োগ পান তিনি। আবার শিবলী রুবাইয়াতের সরাসরি ছাত্র এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধাভোগী অর্থ মন্ত্রণালয়ের শেয়ারবাজার বিভাগের প্রধান ড. নাহিদ হোসেন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি একই দায়িত্বে রয়েছেন। বিএসইসিতে চেয়ারম্যান হিসাবে শিবলী রুবাইয়াতের দ্বিতীয়বার নিয়োগে পূর্ণ সহায়তা করেন তিনি। ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে শিবলী রুবাইয়াত ও ড. শামসুদ্দীন আহমেদ সরকারের নির্দেশে পদত্যাগ করেন। কিন্তু অপর দুই কমিশনার ড. তারিকুজ্জামান এবং ড. মোহসিন চৌধুরী স্বপদে বহাল রয়েছেন। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি ড. নাহিদ হোসেন। এ অবস্থায় তারিকুজ্জামানকে পদত্যাগের জন্য সোমবার বিকালে মোবাইল ফোনে কল করেন তিনি। ফোনে ড. নাহিদ বলেন, ‘অর্থ উপদেষ্টা আপনাকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। রাতেই ইমেইলে পদত্যাগপত্র পাঠান।’ তারিকুজ্জামান বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি কাল সকালে মন্ত্রণালয়ে এসে উপদেষ্টা মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে তার হাতে পদত্যাগপত্র দেব।’ জবাবে ড. নাহিদ বলেন, ‘আপনি পদত্যাগের পর দেখা করেন, তিনি (অর্থ উপদেষ্টা) ব্যস্ত আছেন, কাল আপনি শিডিউল পাবেন না। তাছাড়া আপনি কিন্তু উপদেষ্টার নির্দেশনা না মেনে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করছেন।’ তারিকুজ্জামান বলেন, ‘আমি সরকারকে চ্যালেঞ্জ করছি না, উলটো সসম্মানে তার হাতে পদত্যাগপত্র দিতে চাচ্ছি।’ ড. নাহিদ বলেন, পদত্যাগের দুইদিন পর আপনি দেখা করেন।’ তবে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেননি তারিকুজ্জামান। এদিকে অর্থ উপদেষ্টার দপ্তর সূত্র মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানায়, উপদেষ্টা এ ধরনের কথা কাউকে বলেননি। কেউ বলে থাকলে এটি তিনি ব্যক্তিগতভাবে বলেছেন। এছাড়াও কমিশনার তারিকুজ্জামানের পদত্যাগ চেয়ে অর্থ উপদেষ্টার কাছে শিক্ষার্থীদের নাম করে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে তারিকুজ্জামানের পদত্যাগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে চিঠিতে কারও স্বাক্ষর নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই চিঠি যুগান্তরের হাতে এসেছে। একইদিন কিছু লোক দিয়ে তারিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে মিছিল করে একটি পক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ড. নাহিদ ব্যক্তিগতভাবে শিবলী রুবাইয়াতের সহযোগী এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম সুবিধাভোগী। সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক (ডিএসই) স্বতন্ত্র পরিচালক হয়েছেন নাহিদ হোসেন। বর্তমানে বিষয়টি শেয়ারবাজারে সবার মুখে মুখে। কারণ, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ কর্তৃপক্ষ অর্থ মন্ত্রণালয়। আবার স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগ কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ফলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, আবার যিনি সুনির্দিষ্টভাবে শেয়ারবাজারের দায়িত্বে রয়েছেন, তিনি কোনোভাবেই ডিএসইর পরিচালক হতে পারেন না। এ ব্যাপারে স্টক এক্সচেঞ্জের এক কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের কাজ হলো নিজের নাতনিকে বিয়ের করার সমান। এর ফলে এই কর্মকর্তা স্টক এক্সচেঞ্জে কোনো অনিয়ম করলে বিএসইসি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপরে ক্ষমতাবান। এছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শেয়ারবাজারের প্রশিক্ষক একাডেমি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট (বিআইসিএম) এবং বিএসইসির আওতাধীন বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটে (বিএএসএম) খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে ক্লাস নেন তিনি। এক্ষেত্রে প্রতি লেকচারে তিনি ১০ হাজার টাকা করে সম্মানি নেন।
জানতে চাইলে ড. নাহিদ হোসেন মঙ্গলবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) থেকে কাউকে পদত্যাগের জন্য ফোন দেওয়া হলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে দেওয়া হয়।’ তবে তার সঙ্গে এ বিষয়ে ড. তারিকুজ্জামানের কোনো কথা হয়নি। তিনি বলেন, বিএসইসি থেকে চিঠি দিয়ে এফআইডির একজন প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছে। সে হিসাবে তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন।
bsec commissioner