এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম নিজেই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরিচালক ছিলেন তাঁর স্বজনেরা।
এবার বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কবজা থেকে মুক্ত হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। গতকাল রোববার ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান করা হয় ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে। স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. আজিজুর রহমান, উত্তরা ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মো. আবদুল কুদ্দুছ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. সাইফুল আলম ও হিসাববিদ মো. রাগিব আহসানকে।
যখন এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক দখল করে, তখন আবদুল মান্নানকে তুলে নিয়ে পদত্যাগ করানো হয়েছিল। এখন তাঁকেই এস আলমের মালিকানাধীন এই ব্যাংক পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম নিজেই ছিলেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ব্যাংকটিতে পরিচালক ছিলেন তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীন, বোন আতিকুর নেসা ও ভাই মোহাম্মদ আবদুল্লাহ হাসান। এর আগে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয় ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। এ ছাড়া ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকেও (ইউসিবি) পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে পুনর্গঠন করা হয়।
ব্যাংক সংস্কার কর্মসূচির আওতায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি গতকাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডির কাছে পাঠানো এক আদেশে জানায়, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে এ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে। ওই আদেশে বলা হয়, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিত করা ও জনস্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে পরিচালনা পর্ষদ নতুনভাবে গঠনের জন্য পাঁচজনকে পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকটি গভীর সংকটে
২০০৪ সালে সিকদার গ্রুপের কাছ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এস আলম গ্রুপের কাছে। তখন থেকে এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম নিজেই। নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ব্যাংকটিকে ইসলামি ধারার ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ঋণের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকাই রয়েছে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে।
এই ঋণসহ এস আলম গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ বছরের পর বছর পার হওয়ার পরও আদায় হয়নি। আবার এসব ঋণকে খেলাপি হিসেবেও দেখানো হয় না। শুধু সুদ যুক্ত হয়ে বেড়েছে। ফলে ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়েছে। ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলতে পারছেন না গ্রাহকেরা। কর্মকর্তাদের বেতন হলেও তাঁরা টাকা তুলতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে গত ২৭ আগস্ট ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
জানা যায়, ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকটিতে মোট আমানত ছিল ৪৫ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। অথচ তখন ঋণের স্থিতি ছিল ৫৬ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ বেশি দিয়েছে ব্যাংকটি। এই অতিরিক্ত টাকা এসেছে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংকসহ গ্রুপটির মালিকানাধীন অন্য ব্যাংকগুলো থেকে। এই টাকা দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, যা ফেরত পাচ্ছে না ওই ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো নিরাপত্তা জামানত ছাড়া ব্যাংকটিকে টাকা ধার দিয়েছে, যা এখন ফেরত পাচ্ছে না।
ব্যাংকটি আমানত বাড়াতে যেনতেনভাবে শাখা খুলেছে, অন্যদিকে জনবল নিয়োগ দিয়েছে যোগ্যতা না দেখে। এস আলমের নিজের এলাকা চট্টগ্রামের ‘পটিয়া’র মানুষেরাই নিয়োগে বেশি প্রাধান্য পেয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংকটিতে জনবল ছিল ৫ হাজার ৩২৪ জন। শাখা ছিল ২০৫টি ও উপশাখা ১৭৪টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তাঁর পরিবারের এক সদস্য এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রয়াত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর নামে ঋণ বের করা হয়। এই ঋণ নিয়ে তাঁদের নামে শেয়ার কিনে ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক করা হয়েছিল। তাঁদের (এরশাদ ও বাবলু) মৃত্যুর পর সেই শেয়ারের হস্তান্তর হয়েছে, কিন্তু ব্যাংকের ঋণ শোধ হয়নি।
অনিয়ম প্রকট হওয়ায় গত বছর ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি, উল্টো আরও খারাপ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকটিকে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দিয়েছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পর গভর্নর পদে আহসান এইচ মনসুর যোগ দিলে সেই সুবিধা বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর গতকাল ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
গতকাল সকালে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কর্মকর্তারা এস আলম গ্রুপের ঋণের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁরা কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
first security islami bank chairman