August 25, 2025 11:43 am
Home Stock Market নানা অনিয়মের বেড়াজালে চার্টার্ড লাইফ

নানা অনিয়মের বেড়াজালে চার্টার্ড লাইফ

by fstcap

নানা অনিয়ম আর অসঙ্গতিতে ভরপুর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন। শুধু তাই নয়, নানাভাবে কোম্পানিটির আইন লঙ্ঘনের নমুনাও উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনের পরতে পরতে।

২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবেদনের ১৮২ পৃষ্ঠায় স্টেটমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল পজিশন অংশে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন কোম্পানিটির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার আবু আহমাদ কবির। এছাড়া ১৮৩-১৮৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত রেভিনিউ অ্যাকাউন্ট, ১৮৬ পৃষ্ঠায় ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট, ১৮৭ পৃষ্ঠায় স্টেটমেন্ট অব চেইঞ্জেস ইন শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটি, ১৮৮ পৃষ্ঠায় স্টেটমেন্ট অব লাইফ ইন্স্যুরেন্স ফান্ড, ক্ল্যাসিফাইড সামারি অব দ্য অ্যাসেটস ইন বাংলাদেশ অংশে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন কোম্পানিটির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার আবু আহমাদ কবির।

নোটস টু দ্য ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টসের শেষে ২০৫ পৃষ্ঠাতেও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আবু আহমাদ কবিরের স্বাক্ষর রয়েছে। এছাড়া ২০৬, ২০৭, ২০৮, ২০৯, ২১১ পৃষ্ঠাতেও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আবু আহমাদ কবিরের স্বাক্ষর রয়েছে। অথচ চলতি বছরের ৬ এপ্রিল কোম্পানিটির নিয়মিত সিইও এস এম জিয়াউল হক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়ার পর তার স্থলে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহকে ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ৯ জুলাই চার্টার্ড লাইফের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী হিসেবে মুহাম্মদ আসিফ শামসকে নিয়োগ দেয়ার আগ পর্যন্ত এমদাদ উল্লাহ ওই পদে দায়িত্ব পালন করেন। প্রশ্ন উঠেছে ভারপ্রাপ্ত সিইও থাকা সত্ত্বেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার নিজেকে ভারপ্রাপ্ত সিইও লিখে কীভাবে বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন। নিয়মানুযায়ী, বীমা কোম্পানিতে কাউকে ভারপ্রাপ্ত সিইও করতে হলে আইডিআরএকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হয়। যখন তখন যে কেউ ভারপ্রাপ্ত সিইও হয়ে কার্যক্রম পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। অথচ এক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে আইনের লঙ্ঘন করে চার্টার্ড লাইফের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার আবু আহমাদ কবির নিজের নামের পাশে ভারপ্রাপ্ত সিইও লিখে হিসাব বিবরণীতে স্বাক্ষর করেছেন। এমনকি কী কারণে তিনি ভারপ্রাপ্ত সিইও লিখে স্বাক্ষর করেছেন সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাও প্রতিবেদনে দেয়া হয়নি। অপরদিকে বার্ষিক প্রতিবেদনের ২৪ পৃষ্ঠায় বোর্ড অব ডিরেক্টরসের তালিকায় ভারপ্রাপ্ত সিইও মুহাম্মদ আসিফ শামসকে এক্স অফিসিও ডিরেক্টর বা পদাধিকারবলে পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) তাকে সিইও হিসেবে অনুমোদন দেয়ার আগেই আইন লঙ্ঘন করে এটি লেখার সুযোগ আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের ৫৩-৫৪ পৃষ্ঠায় ম্যাসেজ ফ্রম দ্য সিইও শেষে আসিফ শামস ভারপ্রাপ্ত বাদ দিয়ে সরসরি নিজেকে চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ আইন অনুযায়ী আইডিআরএ কোনো বীমা কর্মকর্তাকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অনুমোদন দেয়ার আগ পর্যন্ত এভাবে পদবি ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবে আইনের লঙ্ঘন।

কোম্পনিটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রেও আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের তালিকায় ১১ জন উদ্যোক্তা ও ২ জন স্বতন্ত্র পরিচালক দেখানো হয়েছে। এখানে ৩ জন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড অনুযায়ী এটি মানা বাধ্যতামূলক। কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড পরিপালন আইনটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ২সিসি এর অধীন ইস্যুকৃত আইন। তাই এ আইন স্বতন্ত্র পরিচালক সংক্রান্ত বীমা আইনকে সুপারসিড করে। সেক্ষেত্রে বিএসইসির স্বতন্ত্র পরিচালক সম্পর্কিত রেশিও ১/৫ পরিপালন করতেই হবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে বিএসইসির আইন পরিপালনে ব্যর্থতায় (এসইসি/ সিএমআরআরসিডি/২০০৯-১৯৩/০৮) প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কোম্পানি জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরের আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া ২০২৪ সালে লাইফ ফান্ড বাড়লেও প্রবৃদ্ধির হার ছিল হতাশাজনক। ২০২৪ সালে লাইফ ফান্ড বেড়ে ৬৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা হলেও ২০২৩ সালে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৫.৪০ শতাংশ আলোচ্য বছরে যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮.২৪ শতাংশে। ২০২৪ সালে কোম্পানিটির এফডিআর দেখানো হয়েছে ৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী যা পরিশোধিত মূলধনের সমপরিমাণ থাকার কথা। আইন অনুযায়ী এর নিচে রাখার সুযোগ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।

ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড নিয়েও বিএসইসির সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করেছে চার্টার্ড লাইফ। আইপিওতে আসার সময় শ্রমিকদের ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরবর্তীতে তা রক্ষা করেনি কোম্পানিটি।

মূলত নিট প্রফিটের ৫ শতাংশ টাকা এ ফান্ডে রাখার বিধান রয়েছে। আইন পরিপালনে এমন অবজ্ঞা ও অবহেলা কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের অদূরদর্শিতার সাক্ষ্য বহন করে। আইন পরিপালনে অবহেলায় জরিমানা কি হতে পারে গ্রামীণ ফোন কোম্পানিই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এ আইন পরিপালনের ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিগুলোকে অব্যাহতি দেয়নি সরকার। আইন পরিপালনে কেন উদাসীনতা এমন প্রশ্নের জবাবে চার্টার্ট লাইফের কোম্পানি সচিব জি এম রাশেদ বলেন, আগে থেকেই এই ভুল হয়ে আসছিল। এখন আমাদের নজরে এসেছে, ভবিষ্যতে পরিপালনের চেষ্টা করব। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগেও আইনের ব্যত্যয় হয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, এখানে আমাদের ব্যর্থতা এবং অবজ্ঞা স্বীকার করে নিচ্ছি।

লভ্যাংশ না দিতে নানা ছলচাতুরি:
চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে লভ্যাংশ না দিতে নানা ছলচাতুরির অভিযোগ তুলেছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দাবি করেছেন, ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে কৃত্রিমভাবে লোকসান দেখিয়ে কোম্পানি লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত ১৭ জুলাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন বিনিয়োগকারীরা। একই চিঠি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবরও পাঠানো হয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকেই কোম্পানির আয় ও জীবনবীমা তহবিলের (লাইফ ফান্ড) পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু বছর শেষে শেয়ারপ্রতি ১১ পয়সা লোকসান দেখানো হয়েছে, যা লভ্যাংশ না দেয়ার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকেই আবার মুনাফা হয়েছে। এ পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের মনে নানা সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে চার্টার্ড লাইফের লাইফ ফান্ড ছিল ৫৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা বছরের শেষে দাঁড়ায় ৬৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকায়। তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত প্রতিটি প্রান্তিকেই আয় বাড়লেও চতুর্থ প্রান্তিকে লোকসান দেখানো হয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকের শেষেও লাইফ ফান্ড বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকায়।
কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি ১৬ পয়সা মুনাফা ছিল। সমাপ্ত বছরে মোট প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ৮৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং নিট প্রিমিয়াম আয় ৮৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। যা আগের বছরে ছিল যথাক্রমে ৯৬ কোটি ৮১ লাখ ও ৯৪ কোটি ২৯ লাখ।
কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (ঘঅঠচঝ) দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৯৪ পয়সা যা আগের বছরে ছিল ১৩ টাকা ৬০ পয়সা।

এ বিষয়ে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম গণমাধ্যমকে বলেন, “অভিযোগ যাচাই করে যদি কোনো ধরনের জালিয়াতির প্রমাণ মেলে, সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

২০২৪ সালের লভ্যাংশ না দেয়ার প্রস্তাব আজ ২৫ আগস্টের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এর আগে ২০২৩ সালে কোম্পানি মাত্র ২.৫% নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।

CLICL

https://bankbimaarthonity.com/নানা-অনিয়মের-বেড়াজালে

You may also like