দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক, প্রবাসী আয় যখন উর্ধ্বমূখী তখন পুঁজিবাজারের সূচক টানা নিম্মমূখী। টানা সূচক পতনে কাপন ধরেছে বিনিয়োগকারীদের মনে। সঙ্কায় আছেন আদো ভালোভাবে আগামী রমজান বা ঈদুল ফিতর পালন করতে পারন তারা।
বিএসইসির ঘন ঘন সিদ্ধান্ত, তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সাথে তালিকাবহিভূত ব্যাংকের মার্জার, আইএমএফ এর চাপে সূদহার বৃদ্ধি ও ক্যাপিটাল গেইনের উপর কর আরোপের আলোচনা সব শেষ যুক্ত হয়েছে কমিশনের শীর্ষ কর্তাদের নবায়ন বা নিয়োগ নিয়ে গুনজন। এমন অবস্থা প্রতিদিনই কমছে সূচক ও বাজার মূলধন। এতে করে নতুন করে রাস্তায় নামছে বিনিয়োগকারী।
ডিএসই সূত্র মতে, গত ১১ ফেব্রুয়ারিও সূচক ছিল সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছুঁই ছুঁই, আর লেনদেন ছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটির বেশি। ফুরফুরে ছলছিল সবকিছুই। তবে ধারাবাহিক পতনের শুরুটা হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি যখন ২২টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানো হয় তখন থেকে। মূলত জেড ক্যাটাগরি নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) আর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়হীনতার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে তখন। চলতে থাকে নানা আলোচনা-সমালোচনা। আতঙ্ক দেখা দেয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরের ফলে কোম্পানিগুলো নন-মার্জিনেবল হয়ে যায়। ফলে বাড়তে থাকে ফোর্সসেল।
এমন অবস্থায় বিএসইসির শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্য দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়, নতুন করে আর কোন কোম্পানি যাবে না জেড ক্যাটাগরিতে। এর দুই কার্যদিবস পরই নতুন করে আরও ছয়টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে হস্তান্তর করে ডিএসই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাণিজ্য প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, বিএসইসির সাথে আলোচনা করেই জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানো হয়েছে কোম্পানিগুলোকে। এখানে ডিএসইর কোন কিছু করার নেই। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন বিএসইসির কমিশনার ড. শামসুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা ডিএসইকে একটি গাইড লাইন দিয়েছে ,সেই আলোকেই তারা সিদ্ধান্ত নিবে।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি ও দূর্বল ব্যাংকের সাথে তুলনামূলক সবল ব্যাংকের মার্জার। একই সাথে বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল গেইনের উপর বাড়তি কর আরোপের আলোচনা। এমন পরিস্থিতিতে আস্থার সংকট দেখা দেয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। সাইড লাইনে চলে যায় বড় বিনিয়োগকারীরা। এতে করে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায় পুঁজিবাজারে। ফলে প্রতিদিনই কমছে সূচক ও মূলধন। নি:শ্ব হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বাণিজ্য প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে মূলত যে সমস্যাটা হচ্ছে তা হল ফোর্সসেল। যেসব কোম্পানিকে হঠাৎ করে ডিএসই জেড ক্যাটাগরিতে পাঠিয়ে দিল, সেগুলো কিন্তু নন-মার্জিনেবল হয়ে গেল। অর্থাৎ যেসব বিনিয়োগকারী এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মার্জিন লোন নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা আর তার আওতার মধ্যে পড়বেন না। এতে করে কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ বাঁচাতে শেয়ার ফোর্সসেল করে তাদের বিনিয়োগ নিয়ে নিচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানকে এখন এসে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানো হলো, এগুলো তো আরও আগেই জেডে যাওয়ার যোগ্য ছিল। তাহলে কার স্বার্থে এতদিন অপেক্ষা করা হলো? কেন এতদিন এসব কোম্পানিকে জেডে যেতে আটকে রাখা হয়েছিল? জেড ক্যাটাগরি নিয়ে ডিএসই এক কাজ করে আবার বিএসইসি করে আরেকটা। এতে তো স্পষ্ট হয়ে যায় বিএসইসি আর ডিএসইর মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এসবের দায়ভার নিতে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।’
সামনে আসছে ঈদ। আর প্রতিবারই ঈদের আগে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা টাকা তুলে নিতে চান বিনিয়োগকারীরা। তবে এবার ঈদটা বোধহয় একটু ভিন্ন হতে যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে মুনাফা তো দূর, উল্টো বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। ধারাবাহিক পতনের ফলে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী। ঈদের আগে বাজারের এমন চিত্র মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই।
বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বভাবতই প্রতি ঈদের আগে শেয়ার বিক্রি করার কিছুটা চাপ দেখা যায়। অনেকে মুনাফা তুলে নেন আবার অনেকে মূল পুঁজিই তুলে নেন ঈদের বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য। তবে এ বছর টানা পতনের কারণে লোকসানে রয়েছেন প্রায় সবাই। ফলে মুনাফা বা মূল পুঁজি তুলতে পারছেন না প্রায় বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী।
তথ্য অনুযায়ী, জেড ক্যাটাগরি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার মধ্যেই গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২২টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়। এরপরই মূলত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় আতঙ্ক ঝেঁকে বসে। কখন আবার তাদের বিনিয়োগ করা কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয় এ নিয়ে দুশ্চিন্তার উদ্রেক হয়। ফলে তারা কোনোরকম শেয়ার বিক্রি করে বের হওয়ার চেষ্টা করে। সেদিন ডিএসই সূচক ৫৩ দশমিক ২ পয়েন্ট কমে নামে ৬ হাজার ২৮৩ দশমিক ২৩ পয়েন্টের ঘরে। এরপর তা ধারাবাহিক কমতেই থাকে। ফলে দিন দিন বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও নেতিবাচক হতে থাকে। দিশেহারা হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা।
মাসুম আহমেদ নামে একজন বিনিয়োগকারী বাণিজ্য প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামনে আসছে ঈদ। ভেবেছিলাম ঈদের আগে আমার বিনিয়োগ করা টাকাগুলো থেকে কিছুটা লাভ করে ঈদটা ভালো করে করব, তা আর হবে না। উল্টো এখন আমার পুঁজিই হারিয়ে যাচ্ছে। আমার ঈদ আর করা হবে না।
তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক হারিয়েছে ২৫ দিন। এরমধ্যে মাত্র ৫ কার্যদিবস সূচকের উত্থান হয়েছিল। টানা এই দরপতনের ফলে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৯৬ হাজার ৭৮৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। টানা দরপতনের ফলে বাজার মূলধনের ওপর এতটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পুঁজি হারিয়ে এখন নিঃস্ব অনেক বিনিয়োগকারী।
বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ কাদের বলেন, ‘কত কষ্টের টাকা এই বাজারে বিনিয়োগ করেছি। ভেবেছিলাম ঈদের আগে একটা ভালো রিটার্ন করে ঈদটা ভালমত করতে পারব, এখন দেখছি আমার পুঁজি বাঁচানোই দায়।’
অনেকটা মনের ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের মত এত অস্থির পুঁজিবাজার বিশ্বে দ্বিতীয়টা আর নেই। ভারতের বাজারে দেখলাম মার্চে ৩৮ হাজার কোটি রুপির বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে। আমাদের আশেপাশের অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারও ভালো করছে। শুধু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের অবস্থাই খারাপ। এরজন্য কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দ্বায় এড়াতে পারেন না।’
বাজার পর্যালোচনা:
তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ জানুয়ারি ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দিন ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৬ হাজার ৩৩৬ পয়েন্ট। গতকাল বুধবার লেনদেন শেষে সূচক দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৬২ পয়েন্ট। এতে ফ্লোর প্রত্যাহারের পর সূচক কমেছে ৫৭৪ পয়েন্ট।
ডিএসইএক্স ৭১ দশমিক ৭০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৭৬২ পয়েন্টে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরীয়াহ সূচক ১৪ দশমিক ৮১ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ২৫২ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক ১২ দশমিক ৮৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১২ পয়েন্টে।
গতকাল ডিএসইতে ৫৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কর্মদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৪৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকার। আগের দিনের চেয়ে লেনদেন বেড়েছে ১৮৭ কোটি টাকার বেশি। ডিএসইতে ৩৯৬টি প্রতিষ্ঠানের ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৩৮টির, কমেছে ৩২১টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৭টির।
অপর পুঁজিবাজার চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) গতকাল বুধবার ৯ কোটি ৯৯ লাখ ৮১ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৬ কোটি ২৮ লাখ ১ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট। সিএসইতে ২২৬টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৪০টির, কমেছে ১৬৭টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের।
যা বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আল আমিন বাণিজ্য প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইস দেয়ার বিরুদ্ধে অনেকেই দেখছি এখন কথা বলছেন। যেহেতু পুঁজির নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাই আপাতত কিছুদিন পুঁজিবাজার বন্ধ ঘোষণা করা হোক।’
তিনি বলেন, ‘এরপর অনুসন্ধান করে বের করা হোক কারা ফ্লোর তুলে দেয়ার পর ১৭০০ কোটি টাকা লেনদেন করেছিল? আর এখন কেন ৪০০ কোটি টাকার নিচে লেনদেন?এসব প্রশ্নের উত্তর খুজে বের করে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে, লেনদেন চালু করা হোক। এভাবে পুঁজিবাজার চলতে পারে না।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, প্রতিবছর ঈদের আগে শেয়ার বেচে টাকা তুলে নেয় অনেকেই। এবার পারবে না। এবার আয় হয়নি। শুধু পুঁজিটা নিতে পারবে। যেভাবে পুঁজিবাজার পড়ছে বা পড়েছে, এতে কারও মুনাফা হয়েছে বলে মনে হয় না। হলেও খুবই কম সংখ্যকের হয়েছে।
শিগগিরই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে এমন প্রত্যয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশের পোর্টফোলিও নেতিবাচক অবস্থায় আছে। অনেকেই হয়তো তারপরও টাকা তুলে নেয় বা নেবে। বাজার এ বছর অনেক বেশি সংশোধন হচ্ছে। অনেক মৌলভিত্তির শেয়ার যৌক্তিক দামে চলে এসেছে।’
Source: banijjoprotidin
BD share market poor condition DSE bearish