বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পর এখন দেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান সার্বিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এগুলোর যেমন আয় কমেছে, তেমনই বেড়েছে ব্যয়। খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে। মূলধনে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ সামান্য কমলেও এখনো তা ৬৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। কমেছে সম্পদের মান। আমানতের চেয়ে ঋণ বিতরণ বেশি হওয়ায় তারল্য ব্যবস্থাপনায় বেড়েছে চাপ।
বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এখনো আমানতকারী, ব্যাংক ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায় পরিশোধ করতে পারছে না। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর আগে যে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, এর নেতিবাচক প্রভাব এখন আরও প্রকট হচ্ছে। জালিয়াতির ক্ষত এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সব সূচকে ফুটে উঠেছে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। এতে পরিচালকরা আত্মসাৎ করেছেন ৬ হাজার কোটি টাকা। জালিয়াতির নায়ক পি কে হালদার গং নিয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। ওইসব ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি। বিতরণ করা ঋণ আদায় হচ্ছে কম। এতে আয় কমে গেছে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে বাড়তি প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এতে তহবিল আটকে যাচ্ছে। মূলধন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মূলধনের ঘাটতি বেড়ে গেছে। সার্বিকভাবে সম্পদের মান কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালের মার্চে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন ছিল ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত জুনে তা কমে ৫ দশমিক ০৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সোয়া দুই বছরে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়েছে।
কিন্তু আয় কমায় এর বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সার্বিক মূলধন কমার পাশপাশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন রাখার হার কমে গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা কমেছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়েছে এবং সম্পদের মান কমেছে; অন্যদিকে প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ২০২১ সালের জুনের তুলনায় কমলেও এখনো তা ৬৮ হাজার কোটি টাকার ওপরে রয়েছে। ৫ বছরের ব্যবধানে জালিয়াতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত তিন বছর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ৭২ থেকে ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। বর্তমানে মোট সম্পদের পরিমাণ ৯৮ হাজার কোটি টাকা।
মোট সম্পদের প্রায় ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে। যাকে অনেকেই অত্যন্ত উদ্বেগজনক হিসাবে মনে করেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০২১ সালের জুনে মূলধন ছিল ৯ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। গত জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। গত দুই বছরে মূলধন কমেছে ৬ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশ। এটিকেও অত্যন্ত উদ্বেগজনক মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মূলধন কমার অন্যতম কারণ মাত্রাতিরিক্ত হারে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি ও আয় কমে যাওয়া। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানকে এখন মূলধন ভেঙে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হচ্ছে। এ প্রবণতা অবিলম্বে রোধ করা না হলে মূলধন আরও কমে যাবে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। এখন তা দ্বিগুণ বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আড়াই বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণ। একই সময়ে খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে।
ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাহকদের আমানতের নিরাপত্তার জন্য নির্ধারিত হারে অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এর মধ্যে নগদ আকারে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) ও বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করে বিধিবদ্ধ আমানত (এসএলআর) হিসাবে রাখতে হয়।
২০২১ সালের জুনে সিআরআর খাতে উদ্বৃত্ত ছিল ৬৭ কোটি টাকা। মাঝে কিছু সময় ঘাটতি ছিল। গত ডিসেম্বরে উদ্বৃত্ত কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ কোটি টাকায়। গত জুনে তা আরও কমে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৩১ লাখ টাকা। একই সময়ে এসএলআর উদ্বৃত্তও কমেছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে এসএলআর খাতে সর্বোচ্চ উদ্বৃত্ত ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে তা কমে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। এগুলো সবই ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর। দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত নেই বললেই চলে। টাকার প্রবাহ কমায় এসব খাতে উদ্বৃত্ত কমেছে। এতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কমেছে। কারণ, এসব খাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকলে যে কোনো দুর্যোগে প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ এনে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে পারে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিনিয়োগ, ঋণ বা লিজ থেকে আয় ছিল দশমিক ২৯ শতাংশ। এখন তা কমে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ নেতিবাচক। অর্থাৎ বিনিয়োগের বিপরীতে কোনো আয় তো হচ্ছেই না, উলটো লোকসান হচ্ছে। প্রতি ১০০ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে লোকসান হচ্ছে ১ টাকা ৪৩ পয়সা।
একই সময়ে মূলধনের বিপরীতে আয় ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ থেকে কমে ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ নেতিবাচক, যা স্মরণাতীতকালের মধ্যে রেকর্ড। অর্থাৎ ১০০ টাকার মূলধনের বিপরীতে লোকসান হচ্ছে ৩২ টাকা ৫০ পয়সা। গত বছরের জুনে এ খাতে আয় নেতিবাচক ছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে মূলধন থেকে লোকসান বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ গুণ।
জালিয়াতির কারণে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ২০১৯ সাল থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সার্বিক আমানত কমতে ছিল। গত বছর থেকে আমানত কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে আমানত বেড়েছে দশমিক ৭৫ শতাংশ।
একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে ঋণ বেড়েছে বেশি। অন্যদিকে বিতরণ করা ঋণ আদায় কমে গেছে। মুনাফা বা সুদ আয়ও কম। ফলে তারল্যের প্রবাহ কমে গেছে। এতে টাকার সংকট বেড়েছে। এ সংকট মেটাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারদেনা বেড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান চড়া সুদে ধারও পাচ্ছে না। এতে আমানতকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।