Home National লাফার্জকে গ্যাস দিয়ে ৭০০ কোটি গচ্চা

লাফার্জকে গ্যাস দিয়ে ৭০০ কোটি গচ্চা

by fstcap

বেশি দাম দিয়েও ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না দেশের বিভিন্ন খাতের শিল্পকারখানা। চরম সংকটাপন্ন অবস্থাতেই ফ্রান্সভিত্তিক বহুজাতিক সিমেন্ট কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের (এলএইচবিএল) সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি করে এখন উল্টো বিপদে সরকার। শিল্পকারখানায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও চুক্তিমূল্যে গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে এখন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার অধীন জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডকে (জেজিটিডিসিএল) লোকসান গুনতে হবে মাসে ২৬ কোটি টাকা। ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এই লোকসান টানতে হবে। এতে আগামী দুই বছরে সরকারের গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকার বেশি।

সরকার নির্ধারিত দামে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ না করার কারণে সম্প্রতি লাফার্জহোলসিমের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি নবায়ন করবে না বলে চিঠি দিয়েছে জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি। জালালাবাদের সঙ্গে লাফার্জহোলসিমের ২০ বছর মেয়াদি গ্যাস সরবরাহ চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি শেষ হবে।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তারা গ্যাস পাচ্ছেন না, তারা শত শত কোটি টাকা লোকসান গুনছেন, তখন বিদেশি কোম্পানিকে অনেক কম দামে গ্যাস সরবরাহ করা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এখন বাংলাদেশ বেশি দামে এলএনজি কিনে সরবরাহ করছে। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি সরবরাহের চুক্তি সাবধানে করতে হবে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশি-বিদেশি শিল্পকারখানার গ্যাসের দামের ক্ষেত্রে একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। সিমেন্ট শিল্পে অনেক গ্যাস লাগে। লাফার্জহোলসিমের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তা

খতিয়ে দেখা দরকার।

এ বিষয়ে কথা বলতে জেজিটিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মো. শহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) সর্বশেষ যে ট্যারিফ নির্ধারণ করেছে, সে অনুযায়ী গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বিল আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু লাফার্জহোলসিম নতুন নির্ধারিত ট্যারিফে গ্যাসের বিল দিচ্ছে না। ফলে এখন প্রতি মাসে আমাদের ২৬ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। এমনটা চলতে থাকলে আমরা লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হবো।’ বহুজাতিক এই কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন না করার বিষয়ে চিঠি দেওয়ার কথাও জানান তিনি।

জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, সিমেন্ট শিল্পে অনেক এনার্জি লাগে। আর দামের ক্ষেত্রেও একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। তিনি বলেন, আমাদের স্থানীয় উদ্যোক্তরা বেশি দাম দিয়েও গ্যাস পাচ্ছেন না। আর বিদেশি কোম্পানিকে কম দামে গ্যাস দেওয়া যুক্তিসংগত নয়। লাফার্জের সঙ্গে চুক্তিতে কী কী সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আমরা বেশি দামে এলএনজি আনছি ধার করা ডলার দিয়ে। সেই এলএনজি কম দামে তো সরবরাহ করা যাবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জ্বালানি সরবরাহ চুক্তি আরও সাবধানে করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বহুজাতিক কোম্পানিটির সঙ্গে ২০০৩ সালের ১৯ জানুয়ারি গ্যাস সরবরাহ চুক্তি করে জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি। শর্ত অনুযায়ী ২০ বছর মেয়াদ পূর্তির ১৮ মাস আগে কোনো পক্ষ থেকে চুক্তি নবায়ন অথবা বর্ধিত করার নোটিশ দেওয়া না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঁচ বছর বেড়ে যাবে চুক্তির মেয়াদ। এজন্য জেজিটিডিসিএলের পক্ষ থেকে গত ২৫ জানুয়ারি চুক্তি নবায়ন না করার চিঠি দেওয়া হয়েছে। জেজিটিডিসিএলের এমডি মো. আতিকুর রহমানের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই তারিখের আগেই নবায়ন না করার চিঠি দেওয়ার শর্ত রয়েছে। মেয়াদ শেষে জেজিটিডিসিএল আর চুক্তি নবায়ন করতে চায় না।

বিইআরসি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরই কোম্পানিটির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরপর একাধিক দফায় গ্যাসের দাম বাড়ালেও তারা বর্ধিত মূল্য পরিশোধ থেকে বিরত থাকে।

গ্যাসের দর নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এ-সংক্রান্ত মামলায় আদালতের রায়ে লাফার্জহোলসিমকে বিইআরসির নির্ধারিত দর অনুযায়ী গ্যাস বিল বাবদ ৯০ কোটি ২৫ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোম্পানিটিকে এককালীন ও ত্রৈমাসিক কিস্তিতে এ অর্থ পরিশোধের নির্দেশ দেন। সর্বশেষ গত বছরের ১৩ আগস্টের কিস্তিসহ ৯০ কোটি ২৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে লাফার্জহোলসিম।

জেজিটিডিসিএল ২০২০ সালে তাদের ৪৪৯তম বোর্ড সভায় উল্লেখ করেছে, বিইআরসি ঘোষিত বিদ্যমান দর রয়েছে প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা। অথচ ১০ টাকা ৬৭ পয়সা হারে গ্যাস সরবরাহ করলে কোম্পানি বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বিতরণ চার্জ বাদ দিলে ১৯ টাকা ১৫ পয়সা হারে লোকসান হবে। এতে করে প্রতি মাসে ২৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে জেজিটিডিসিএলকে।

জেজিটিডিসিএলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, লাফার্জহোলসিম এই বিষয়টি নিয়ে সিঙ্গাপুরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যায়। সিঙ্গাপুরে মামলা হলেও শুনানি হয় পর্তুগালে। পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আন্তজার্তিক সালিশি আদালত গ্যাস বিল হিসেবে জালালাবাদকে পরিশোধ করা ৯০ কোটি ২৫ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। জালালাবাদের বিরুদ্ধে এই রায় হওয়ার পর থেকে লাফার্জহোলসিম ফের চুক্তিমূল্যে বিল পরিশোধ করা শুরু করে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চুক্তিমূল্যে গ্যাসের বিল পরিশোধ করা হবে বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। জালালাবাদের হিসাবে চুক্তিমূল্যে গ্যাসের দাম পরিশোধ করলে ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত লোকসান হবে ৭২৮ কোটি টাকা।

১৯৯৭ সালে সুনামগঞ্জের ছাতক শহরের সুরমা নদীর উত্তর পাড় টেংগারগাঁও এলাকায় স্থাপিত হয় লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা। ২০১৫ সালে একীভূত হয় লাফার্জ সুরমা ও হোলসিম সিমেন্ট। হোলসিম সুইজারল্যান্ড ও লাফার্জ প্যারিসভিত্তিক কোম্পানি। একীভূত হয়ে লাফার্জহোলসিম নাম ধারণ করে। দেশের বেসরকারি সিমেন্ট কারখানাগুলোর মধ্যে লাফার্জই একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ কারখানা।

কোম্পানিটির নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে দুটি ও খুলনার মোংলায় একটি গ্রাইন্ডিং স্টেশন রয়েছে। সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার উৎপাদন করে সেখান থেকে সিমেন্ট তৈরি করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানিটির নিজস্ব দুটি সিমেন্ট কারখানায় প্রতিবছর ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন সিমেন্ট উৎপাদন করা হয়, যা দেশের মোট চাহিদার ৭ থেকে ৮ শতাংশ। উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য বর্তমানে লাফার্জের গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন ১ দশমিক ৬ কোটি ঘনফুট।

Source: https://www.kalbela.com/ajkerpatrika/firstpage/64639

LHBL Lafarge

 

You may also like