Home Featured দুর্বলগুলোকে একীভূতকরণের ইঙ্গিত, ৪৫-এ নামতে পারে ব্যাংকের সংখ্যা

দুর্বলগুলোকে একীভূতকরণের ইঙ্গিত, ৪৫-এ নামতে পারে ব্যাংকের সংখ্যা

by fstcap

দেশের ব্যাংক খাতের সংস্কার ও সুশাসন ফেরাতে ১৭টি কর্মপরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ছয়টি থাকছে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংক খাত সংস্কারসংক্রান্ত, বাকি ১১টি ব্যাংক খাতের ভেঙে পড়া করপোরেট সুশাসন ফেরানোর তাগিদ। পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকগুলোর উন্নতি না হলে সেগুলো অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জ) করার বার্তা রয়েছে। ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমিয়ে ৪৫-এ নামিয়ে আনারও ইঙ্গিত দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি এ আভাস দিয়েছেন।

দেশের সবক’টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে প্রতি ত্রৈমাসিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করে। ‘ব্যাংকার্স সভা’ নামের ওই বৈঠক গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম এ সভায় সভাপতিত্ব করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সেখানেই নতুন কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরবর্তী পর্ষদ সভায় সেগুলো উপস্থাপন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বৈঠকে অংশ নেয়া কয়েকজন ব্যাংক এমডির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের ব্যাংক খাতের সংস্কার ও করপোরেট সুশাসন ফেরানো নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। ব্যাংক এমডিদের উদ্দেশে গভর্নর বলেন, ‘নতুন সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যাংক খাত সংস্কারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সরকারের এ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো হবে। কোনো রাজনৈতিক চাপ আমাদের ওপর নেই। দুর্বল ব্যাংকগুলোর উন্নতি না হলে সেগুলো অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জ) করে দেয়া হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও ব্যাংক নির্বাহীরাও জানান, এবারের ব্যাংকার্স সভার প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল ব্যাংক খাতের সংস্কার ও করপোরেট সুশাসন। প্রভাবশালী ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে। সভায় জানানো হয়, ঋণখেলাপিদের সঙ্গে আর আপস নয়। ব্যাংক খাত আইন অনুযায়ী চলবে। রাজনৈতিক পরিচয়ে আর কোনো সুবিধা দেয়া যাবে না। ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে। মামলায় আটকে থাকা অর্থ আদায়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার বিষয়েও ব্যাংক নির্বাহীদের তাগাদা দেয়া হয়। এছাড়া তারল্য সংকট, ক্রলিং পেগ নীতির বাস্তবায়ন, ডলার সোয়াপের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণীত প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

বৈঠক সূত্র জানায়, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ গণনায় নীতি ছাড় কমিয়ে আনতে চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য ৯০ দিনের মধ্যে ঋণের কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তা খেলাপির খাতায় ওঠার সেই আগের নীতিতে ফিরে যাওয়ার আভাস দেয়া হয়েছে। এ নীতি বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেড়ে যেতে পারে। নীতি ছাড়ের পরও বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। পুনঃতফসিল আর অবলোপনসহ হিসাব করলে ব্যাংক খাতের প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার ঋণ ‘দুর্দশাগ্রস্ত’। 

দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে গত ৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ নামে একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেয়া হয়। দেশের সব ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য এ নীতিমালা পালনে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোকে মার্জার-অ্যাকুইজিশনের আওতায় পড়তে হতে পারে। এ বিষয়ে ব্যাংকার্স সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমরা একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে চাই।’ 

তখন একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানতে চান, একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি কি পর্ষদের সঙ্গে পর্ষদ হবে, নাকি ব্যালান্সশিটের সঙ্গে ব্যালান্সশিট? গভর্নর বলেন, ‘ব্যালান্সশিটের সঙ্গে ব্যালান্সশিট একীভূত হবে। কোনো দুটি ব্যাংক নিজে থেকে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিলে সেটিও বিবেচনায় নেয়া হতে পারে।’ এ সময় গভর্নর ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমিয়ে ৪৫-এ নামিয়ে আনার মনোভাব প্রকাশ করেন।

দেশের ব্যাংক খাতে প্রায় দুই বছর ধরে ডলারের তীব্র সংকট। গত বছর থেকে সংকটের তালিকায় তারল্য বা টাকাও যুক্ত হয়েছে। দেশের প্রায় সব ব্যাংকই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিদিন অর্থ ধার করে দৈনন্দিন লেনদেন সম্পন্ন করছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকার্স সভায় জানানো হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলারের সঙ্গে টাকার সোয়াপের নতুন পদ্ধতি চালু করা হবে। কোনো ব্যাংকের জরুরি ভিত্তিতে টাকার দরকার হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার জমা রেখে টাকা ধার করতে পারবে। আবার ডলারের প্রয়োজন হলে একই বিনিময় হারে টাকা দিয়ে ডলার নেয়া যাবে। দেশে বর্তমানে ডলারের সঙ্গে ডলার এবং টাকার সঙ্গে টাকার সোয়াপ প্রথা চালু আছে।

ব্যাংকার্স সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর সংস্কারের জন্য গত ডিসেম্বরে প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) নীতিমালা জারি করা হয়েছে। সেখানে সংস্কারের ক্ষেত্রে কীভাবে ব্যাংকগুলোর অবস্থান নির্ণয় করা হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা দেয়া আছে। যেকোনো বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকের হিসাব ধরে পরবর্তী বছরের মার্চে ব্যাংকগুলোর চারটি ক্যাটাগরির ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের ব্যক্তিগতভাবে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার প্রতি নজর দিতে বলা হয়েছে। আর যেসব ব্যাংকের অবস্থা একেবারেই দুর্বল, তাদের ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহ থেকে শুরু করে অন্যান্য কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। কোনো ব্যাংক ক্রাইটেরিয়া পূরণে ব্যর্থ হলে বিধিমালার আলোকে সেটিকে একীভূত করা হবে।’

মেজবাউল হক বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছি। সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। তাই আগে থেকে সতর্ক থাকতে তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে, যাতে করে তারল্য ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে পারে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে চাই।’

ব্যাংকের সুশাসন ফেরাতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কমিটি একটি অ্যাকশন প্ল্যান ঠিক করে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করবে। পরে সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। খেলাপি ঋণ কমানো এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার সন্নিবেশ করতে জোর দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে ক্রলিং পেগ নীতি চালু করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার রেখে কারেন্সি সোয়াপ করা যাবে।’ 

আদালতে অর্থ মামলা কমাতে ব্যাংক নির্বাহীদের এডিআরের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে জানিয়ে মেজবাউল হক বলেন, ‘এতে মামলার সংখ্যা কমে আসবে। তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যেন কোনো গ্রাহক এ এডিআরের সুবিধা নিয়ে কালক্ষেপণ করতে না পারে। এছাড়া আমরা কিছুদিন আগে একটি প্রজ্ঞাপন দিয়েছিলাম, ব্যাংককে ঋণগ্রহীতাদের আঙুলের ছাপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের কোনো সমস্যা হবে কিনা সে বিষয়েও পরামর্শ চাওয়া হয়েছে।’ 

ব্যাংকার্স সভা শেষে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ক্রলিং পেগ, পিসিএ, মার্জারসহ নানা বিষয় আলোচনায় এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাগাদা দেয়া হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করে পরিস্থিতির উন্নতি করতে চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পলিটিক্যালি যা-ই হোক না কেন, ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে কোনো ছাড় না দেয়ার নির্দেশনা এসেছে।’

আলোচনার বিষয়ে এবিবির বর্তমান চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিকাঠামো অনুযায়ী ব্যাংক খাত পরিচালিত হবে। খেলাপিদের ধরতে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না। এছাড়া ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে যা যা পদক্ষেপ নেয়া দরকার সবকিছুই করতে গভর্নর কড়া নির্দেশ দিয়েছেন।’ 

source: bonikbarta.com

 

durbol share company ekivutokoron bajimat

 

You may also like