শেয়ার ও সম্পদ বিক্রি নয় বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও নয়, বেক্সিমকোর লে-অফ কোম্পানিগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধ করবে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধ করা হবে রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই। অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত বুধবার ‘বেক্সিমকো শিল্পপার্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’র সপ্তম বৈঠক শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে বেক্সিমকোর লে-অফ কোম্পানিগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হবে। টাকার ব্যবস্থা হচ্ছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি (আগামীকাল) অনুষ্ঠেয় বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
সূত্রগুলো জানায়, প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে কাল মঙ্গলবার উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হচ্ছে না। বৈঠক হতে পারে ২৫ বা ২৬ ফেব্রুয়ারি।
তবে পুরো বিষয়টির একটা ফয়সালা হয়ে গেছে গত সপ্তাহেই। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঋণ দেওয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক হয় গত বুধবার। এ বৈঠকে তিন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিষয়টি সুরাহা করার জন্য। পরদিন বৃহস্পতিবার বৈঠক করেন তিন সচিব। তাঁরা হলেন অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক। তাঁরা সুদমুক্ত ঋণের মাধ্যমে পাওনা পরিশোধের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এই সিদ্ধান্তের পক্ষে আছেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, একটা উপায় বের করা হয়েছে। এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে গত সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণের মাধ্যমে বেক্সিমকোর শ্রমিকদের ২২৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এখন আরও দরকার হবে ৫৫০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা। একই প্রক্রিয়ায় সেটাও দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
সূত্রগুলো জানায়, অসন্তোষ এড়াতে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যে প্রক্রিয়ায় পাওনা পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটিকে যাতে কেউ উদাহরণ হিসেবে না নিতে পারে, সেই চেষ্টা থাকবে সরকারের।
বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গত ১৩ আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন। ২৯ আগস্ট সালমান এফ রহমান, তাঁর ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান, পুত্রবধূ শাজরেহ রহমানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে সালমান এফ রহমানসহ বেক্সিমকোর ২৮ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।
এরও দুই মাস পর গত ২৪ নভেম্বর শ্রম উপদেষ্টাকে আহ্বায়ক করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেক্সিমকোর লে-অফ কোম্পানিগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধে সাত দফা বৈঠক করেছে। কমিটির ষষ্ঠ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাংকের কাছে বন্ধক থাকা বেক্সিমকো গ্রুপের চালু দুই প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুর সিরামিকসের শেয়ার, সম্পদ বিক্রি করে গ্রুপটির লে-অফ থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।
তবে সপ্তম বৈঠকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কমিটি। সূত্রগুলো জানায়, ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেসব ব্যাংক ঋণ দিয়েছিল, সেসব ব্যাংকই পাওনা পরিশোধ করবে। তিন সচিব সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, এটাও কোনো বাস্তবায়নযোগ্য উপায় নয়।
বেক্সিমকো গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংক ২৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংক ১ হাজার ৪২৪ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৪২০ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৯৮৭ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৩১৫ কোটি, ইউসিবি ৩৩৩ কোটি, এবি ব্যাংক ৯৩৮ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৪৯৭ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৬১ কোটি, ডাচ্–বাংলা ব্যাংক ৯৪ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক ৭৮ কোটি এবং বিআইএফএফএল ৮৭ কোটি টাকার পাওনাদার।
বেক্সিমকো শিল্প পার্কের আওতায় থাকা ৩১ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো পিপিই এবং আর আর ওয়াশিং চলমান। বাকিগুলোর মধ্যে ১২টি সাময়িক এবং ১৬টি পুরোপুরি বন্ধ। তাদের বিপরীতে ব্যাংকঋণ ২৮ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। রপ্তানি ক্রয়াদেশ না থাকা ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে না পারায় কারখানাগুলো লে-অফ ঘোষণা করে বেক্সিমকো গ্রুপ। এই ঋণের বিপরীতে জমি, ভবন, যন্ত্রপাতি, শেয়ার, ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ইত্যাদি মিলে বন্ধক রয়েছে মোট ৪ হাজার ৯৩২ কোটি টাকার সম্পদ।
কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহসানুল করিম। সরকারের এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেক্সিমকোর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা কতটুকু ঠিক হচ্ছে, সে বিষয়ে আরও ভাবা দরকার ছিল। তিনি মনে করেন, সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া চলবে। তবে কারখানাগুলো সচল রাখা দরকার; কিন্তু সরকার সে পথে যাচ্ছে না।
Bxpharma Spceramic