দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে একসময়কার পথিকৃৎ ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড। বর্তমানে শীর্ষ ঋণখেলাপি হয়ে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের জুন শেষে কোম্পানিটির ঋণের বোঝা ২ হাজার ২৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। শেষ এক বছরে ঋণের বোঝা প্রায় ১৫৮ কোটি টাকা বেড়েছে, যা ২০টিরও বেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে গভীর সংকটে ফেলেছে।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ২৪৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ২০২৩ সালে ছিল প্রায় ২ হাজার ৮৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৫৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এক বছরে ঋণের এই উল্লম্ফন ২০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিনকে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ২০০০ সাল থেকে দেশে ও বিদেশে কার ফেরি, যাত্রীবাহী জাহাজ, মাছ ধরার বোট, বার্জ, মাছ ধরার ট্রলার, টাগ বোট ইত্যাদি তৈরিতে দক্ষতা দেখায়। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেয়। ২০১৭ সালের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। এরপর করোনাকালে ব্যবসা স্থবির হলে প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়। সরকার ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেয়। পাওনা আদায়ে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আগ্রাবাদ অফিসে নিলামের উদ্যোগ নিয়েছিল ন্যাশনাল ব্যাংক, কিন্তু ঋণ আদায় করা যায়নি। ২০২৪ সালের জুন মেষে এ ঋণ প্রায় ৯৯৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের জুন শেষে এ ঋণ ছিল ৯৩৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এক বছরে ন্যাশনাল ব্যাংকে ওয়েস্টার্ন মেরিনের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৬ কোটি টাকা বেড়েছে।
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের খেলাপি ঋণ আদায়ের বিষয়ে চলতি দায়িত্বে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা এই খেলাপি ঋণ আদায়ে কাজ করে যাচ্ছি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।’
ন্যাশনাল ব্যাংকের পর ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড নিয়ে বিপদে রয়েছে ব্যাংক এশিয়া। ২০২৪ সালের জুন শেষে ব্যাংক এশিয়ার পাওনা প্রায় ৫০৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংক এশিয়া এই ৫০৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। কিন্তু তারপরও ঋণ আদায় হয়নি, বরং সময়ের সঙ্গে দায় বাড়ছে।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ওয়েস্টার্ন মেরিনের ঋণ আদায়ের আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সেইসঙ্গে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থাও চলমান রয়েছে। এর মধ্য দিয়েই আমরা খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছি।’
জাহাজশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়া ওয়েস্টার্ন মেরিনের বকেয়া নিয়ে বিপাকে থাকা আরেক ব্যাংক সোনালী ব্যাংক। ২০২৪ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির পাওনা প্রায় ১৮৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সোনালী ব্যাংকে ওয়েস্টার্ন মেরিনের ঋণের পরিমাণ এক বছরে বাড়ে প্রায় ৭০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বাধ্য হয়ে এই ব্যাংকটিও ঋণ পুনঃতফসিল করে। কিন্তু তাতেও কোনো সুফল মেলেনি।
২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ওয়েস্টার্ন মেরিনের কাছে পূবালী ব্যাংক প্রায় ৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক প্রায় ১৫৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক প্রায় ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক প্রায় ৪৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, ঢাকা ব্যাংক প্রায় ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ওয়ান ব্যাংক প্রায় ৭৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক প্রায় ১৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক প্রায় ৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ও এনসিসি ব্যাংক প্রায় ২৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।
ব্যাংকের মতোই ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে অন্তত সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রিলায়েন্স ফিনান্স প্রায় ২৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা, মাইডাস ফিনান্সিং প্রায় ৫৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, ন্যাশনাল হাউজিং ফিনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ টাকা, ন্যাশনাল ফিন্যান্সের প্রায় ১৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল প্রায় ৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, উত্তরা ফিনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রায় ১০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ও প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিনান্স প্রায় ৪২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা পাওনা আদায় নিয়ে বিপাকে রয়েছে।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, পাওনা ঋণ আদায়ে দেশে শীর্ষ ব্র্যান্ড থেকে শীর্ষ খেলাপি হয়ে ওঠা ওয়েস্টার্ন মেরিনের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ফিন্যান্স, ন্যাশনাল ফিন্যান্স, মাইডাস ফিন্যান্সিং ও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।
এদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ঋণের তথ্য জালিয়াতি করেছে বলে এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। আর্থিক প্রতিবেদনে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি প্রায় ৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বলে দাবি করেছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। কিন্তু ব্যাংক বলছে, প্রকৃত ঋণ ৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। এভাবে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ঋণ কম দেখিয়েছে কোম্পানিটি। একইভাবে প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সে প্রায় ১০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা লাখ ঋণের তথ্য দিলেও প্রকৃত পরিমাণ ৪৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এখানেও ৩৫ কোটি ২৪ লাখ টাকার তথ্য গোপন করেছে বলে অভিযোগ নিরীক্ষকদের।
ব্যবসায়িক অবস্থা ও ঋণ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানি সচিব আবুল খায়ের শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হলে একদিন অফিসে আসেন, এভাবে কিছু বলতে চাই না।’ এরপর কয়েক দফায় কল ও খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে আসা ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত লোকসানে ছিল। তবে সর্বশেষ ২০২৪ সালে মাত্র ৯৫ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা দেখিয়েছে কোম্পানিটি। লোকসান, ঋণের বোঝা ও লভ্যাংশ না দেয়াসহ কয়েকটি কারণে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারাচ্ছে কোম্পানিটি। এর জের ধরে বর্তমানে ওয়েস্টার্ন মেরিনের শেয়ারদর অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে। https://sharebiz.net/ওয়েস্টার্ন-মেরিনের-দায়/
wmshipyard