ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেতন দিতে না পারায় বেক্সিমকো গ্রুপের একাধিক কারখানায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। ওই সময় বেতন দিতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক ৫৫ কোটি টাকা ঋণ ছাড় করে। যদিও জনতা ব্যাংকে গ্রুপটির ২৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকাই এখন খেলাপি।
এ ছাড়া ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার রপ্তানি আয় দেশে আনছে না গ্রুপটি। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা। বর্তমানে তিনি কারাবন্দী।
বেক্সিমকোর শ্রমিকেরা এখন আবার বেতনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। এমন সময় গ্রুপটির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনায় বসেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অধীনে গঠিত ‘সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠান প্রোফাইলিং তৈরিবিষয়ক কমিটি’। এতে গ্রুপটির কারখানা পরিচালনায় ও শ্রমিকদের বেতন দিতে নতুন করে ঋণসুবিধা প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের দেওয়া তিনটি প্রস্তাবের মধ্যে এটিই সুপারিশ পেয়েছে। বেক্সিমকোর প্রাপ্ত মুনাফার পুরোটাই জনতা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে।
বেক্সিমকোর প্রস্তাব
সরকার পরিবর্তনের পর বেক্সিমকো গ্রুপ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে একটি প্রস্তাব জমা দেয়। তাতে তিনটি প্রস্তাব করা হয়। প্রথম প্রস্তাবে বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংকে থাকা ২৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকার ঋণ সুদবিহীন ব্লক হিসাবে রাখার অনুরোধ জানায়। সেই সঙ্গে দায় পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় ও ঋণ পরিশোধে ২ বছরের ছাড় চেয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের অক্টোবর মাসের বেতন দিতে গত মঙ্গলবারের মধ্যে ৬০ কোটি টাকা চেয়েছিল তারা। পাশাপাশি আরও ৭০০ কোটি টাকার ঋণসুবিধা চায় গ্রুপটি। এ জন্য বেক্সিমকো কারখানা কর্তৃপক্ষ নতুন করে ৬৮৩ কোটি টাকার সম্পত্তি (জমি ও শেয়ার) বন্ধক রাখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বেক্সিমকোর সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থের সংস্থান, গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থসংস্থানের জোগান ও পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে বেসরকারিভাবে অর্থের জোগান নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তৃতীয় প্রস্তাবে কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোম্পানি বন্ধ করতে হলে ২৪ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এতে শ্রমিকের পাওনা ৫৫৯ কোটি টাকা। এই টাকা জোগাড় করতে কোম্পানি বিক্রি করা ছাড়া বিকল্প নেই। পাশাপাশি বেক্সিমকো এ–ও জানিয়েছে, তাদের গ্রুপে ৪০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে। তাই তারা কারখানা বিক্রি বা বন্ধ করার পক্ষে নয়।
কমিটির সুপারিশ
বেক্সিমকোর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ‘সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠান প্রোফাইলিং তৈরি বিষয়ক কমিটি’ কারখানাগুলোয় কর্মসংস্থান ও তাদের রপ্তানি আয় এবং বকেয়া ব্যাংক ঋণ আদায়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানিটিকে চালু রাখার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি তারা বলেছে, জনতা ব্যাংকের দেওয়া ২৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকার ঋণ সুদবিহীন ব্লকহিসাবে স্থানান্তর করে কোম্পানি চালু রেখে বেক্সিমকোর ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা যায়। বেক্সিমকোর প্রায় ৬৮৩ কোটি টাকা বাজার মূল্যের সম্পত্তি বন্ধক রাখার প্রস্তাবের বিপরীতে কোম্পানিকে ৬০০ কোটি টাকা ফান্ডেড ও ৪০০ কোটি টাকা নন–ফান্ডেড নতুন রপ্তানি ঋণ দেওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে কমিটি। এই ঋণ দেওয়া হলে নতুন রপ্তানি করা ঋণসুবিধার ৬০০ কোটি টাকা থেকে শুধু শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন ও কোম্পানির পরিচালন ব্যয় হিসেবে নির্বাহ করার শর্ত দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া কোম্পানিটি চালু থাকা অবস্থায় প্রাপ্ত মুনাফা থেকে জনতা ব্যাংকের নিকট দায়বদ্ধ আগের ঋণের দায় পরিশোধ করা যেতে পারে।
জনতা ব্যাংকের ভাবনা
জনতা ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা বলেছেন, একটি গ্রুপকে জনতা ব্যাংক সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। কিন্তু বেক্সিমকো গ্রুপকে তার ১৬ গুণ বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা ব্যাংক কোম্পানি আইন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে করা সমঝোতা স্মারকসহ সব নিয়মনীতির লঙ্ঘন। আবার এর মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপের প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার রপ্তানি আয় দেশে আসছে না। সরকার বদলের আগে প্রতি মাসে যে আয় আসত, এখন তার অর্ধেকও আসছে না।
এদিকে জনতা ব্যাংকের এখন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা নেই। সে জন্য বেক্সিমকো গ্রুপকে নতুন করে কোনো অর্থ দেওয়ার আগ্রহ নেই তাদের। প্রয়োজনে বেতন দেওয়ার জন্য জনতা ব্যাংক অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
তবে এ নিয়ে জনতা ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।