সিমেন্ট খাতের তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ পিএলসির সঙ্গে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডের গ্যাস বিক্রয় চুক্তি (জিএসএ) পাঁচ বছরের জন্য নবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর ফলে ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে পাঁচ বছরের জন্য গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা পাচ্ছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ। গতকাল তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের সঙ্গে জালালাবাদ গ্যাসের চুক্তির বিষয়টি নিয়ে ১৮ ডিসেম্বর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে একটি বহুপক্ষীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ সময় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক মাহমুদ বিন হারুন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আরিফ খান, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ক্রিস্টফ হ্যাসিগ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল চৌধুরী, ডিরেক্টর স্ট্র্যাটেজিক প্রজেক্টস কাজী মিজানুর রহমান ও জিএম করপোরেট অ্যাফেয়ার্স সরকার শোয়েব আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় লাফার্জহোলসিমের সঙ্গে জালালাবাদ গ্যাসের বিদ্যমান যে গ্যাস বিক্রয় চুক্তি রয়েছে সেটির মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে এ বর্ধিত মেয়াদ কার্যকর হবে। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সামনে দুই কোম্পানির মধ্যে নবায়ন চুক্তি স্বাক্ষর হবে। লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ চুক্তির আওতায় সরবরাহকৃত গ্যাস কোম্পানিটির ছাতকে অবস্থিত সুরমা প্লান্টের জন্য অপরিহার্য। সুরমা প্লান্ট বাংলাদেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ প্লান্ট যেখানে ক্লিংকার, সিমেন্ট ও অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদন হয়। পণ্য উৎপাদনের জন্য ভারতের মেঘালয়ে অবস্থিত সম্পূর্ণ নিজস্ব খনি থেকে ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তঃসীমান্ত কনভেয়র বেল্টের মাধ্যমে চুনাপাথর আমদানি করে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ।
সিলেটের সুনামগঞ্জের ছাতকে অবস্থিত কারখানায় গ্যাস সরবরাহের জন্য ২০০৩ সালের ১৯ জানুয়ারি জেজিটিডিএসএল ও লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের মধ্যে একটি জিএসএ স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুসারে, সরকারের ট্যারিফ অনুযায়ী নির্ধারিত দামে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করে আসছিল কোম্পানিটি। তবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কর্তৃক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পর দুই কোম্পানির মধ্যে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বিইআরসির বর্ধিত ট্যারিফ অনুসারে, চুক্তির চেয়ে গ্যাসের দাম বেশি আসে এবং জালালাবাদ সে অনুযায়ী গ্যাস বিল করে। অন্যদিকে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ চুক্তি অনুসারে গ্যাসের দাম পরিশোধের বিষয়ে অনড় থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে এ দ্বন্দ্বের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে গড়ায়। ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের পর্ষদ সভায় গ্যাসের মূল্য নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব আরবিট্রেশনের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সালিশি আদালতের রায়ে গ্যাস বিল বাবদ নেয়া অতিরিক্ত ৯০ কোটি ২৫ লাখ টাকা তালিকাভুক্ত কোম্পানিটিকে ফেরত দিতে বলা হয়েছিল।
দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব নিরসনের পাশাপাশি চুক্তি নবায়নের সিদ্ধান্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ক্রিস্টফ হ্যাসিগ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা আনন্দিত এবং বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়টি সমাধান করেছে, যা বাংলাদেশের বিদেশী বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের প্রতি সমর্থনকে প্রতিফলিত করে।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত বৃহস্পতিবার লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের শেয়ার সর্বশেষ ৫৩ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ার ৫২ টাকা ৫০ থেকে ৭৭ টাকা ৮০ পয়সার মধ্যে ওঠানামা করেছে।
চলতি ২০২৪ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের আয় হয়েছে ২ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিমেন্ট ব্যবসা থেকে ১ হাজার ৬৭১ কোটি ও অ্যাগ্রিগেটস ব্যবসা থেকে ৩৯৮ কোটি টাকা আয় করেছে কোম্পানিটি। চলতি হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসে কোম্পানিটির সিমেন্ট ব্যবসা থেকে আয় কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ এবং অ্যাগ্রিগেটস ব্যবসার আয় বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি। ২০২৩ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক হোলসিম গ্রুপ ও স্পেনভিত্তিক সিমেন্টোস মলিন্স গ্রুপের যৌথ উদ্যোগ লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০০৩ সালে। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৬৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক, ২১ দশমিক ১২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, দশমিক ৮৬ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগকারী ও ১৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে।
LHB