Home Banking দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টেনে তোলার চেষ্টা : সুফল মিলবে কি?

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টেনে তোলার চেষ্টা : সুফল মিলবে কি?

by fstcap

মরিয়ম সেঁজুতি : ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পাহাড়ের চূড়ায়। সুশাসনের অভাবও দীর্ঘদিনের। প্রতিনিয়তই দুর্বল হয়ে পড়ছে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। তারল্য সংকটসহ ব্যাংকগুলোতে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। এমন পরিস্থিতিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দূর করা, পরিচালনা পর্ষদ শক্তিশালী করা এবং প্রশাসনিক ব্যয় কমাতে এ উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে একীভূত হওয়ার তিন বছর পর্যন্ত কাউকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। অর্থনীতিবিদদের মতে, খারাপ ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে ব্যাংক খাতের জন্য সুফল বয়ে আনবে। তবে কিছুটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই বলছিলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু সরকার তা আমলে না নিয়ে একের পর এক ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। যে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের এমন সিদ্ধান্ত শুনবেন না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লোক দেখানো হলে কিছু বলার নেই। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্ত সফল করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কঠিন হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তা আগে দেখতে হবে।

নিয়ম শক্তভাবে প্রয়োগ না হলে কোনো ফল আসবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ব্যর্থতায় পুরনো কিছু নীতির সংশোধন হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যে নীতিমালা ও ক্ষমতা আছে তা দিয়েই ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। ব্যাংকিং খাতে এটিই সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে আছে।
তিনি বলেন, কিছু কিছু ব্যাংকের গভর্নেন্স একেবারেই নেই। খেলাপিতে জর্জরিত, জনগণের আস্থাও নষ্ট হয়ে গেছে এসব ব্যাংকের প্রতি। তাই এসব দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হলে ব্যাংকিং খাতে কিছু সুফল পাওয়া যাবে। গ্রাহকের আস্থাও ফিরে আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এসব দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করবে কীভাবে? বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই জানে না, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত নিবে কীভাবে? মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে একীভূত করার উদাহরণ রয়েছে উল্লেখ করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সফল ও সুন্দর সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তিনি আরো বলেন, শুধু ব্যাংকগুলোই নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এর আওতায় আনতে হবে। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। তাই একটির ত্রæটি ঠিক করা হবে, আর আরেকটি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে তা ঠিক নয়। সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত হতে হবে।
২০০৯ সালে একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছিল উল্লেখ করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শুধু রোডম্যাপ তৈরি করে দিলেই হবে না, একটি সঠিক গাইডলাইনও তৈরি করে দিতে হবে। পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোডম্যাপ উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের বলেন, দুর্বল ব্যাংক সংস্কারের বড় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মূলধন খেলাপি ঋণসহ চারটি সূচকের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে। সবল কোনো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হবে। গত ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকগুলোকে বলে দেয়া হয়েছে যারা দুর্বল তারা আগে থেকে প্রস্তুতি নেবে কার সঙ্গে একীভূত হবে। যদি কেউ এ ধরনের প্রস্তুতি না নেয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে একীভূত করে দেবে বলে জানান তিনি।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে গত বুধবার অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টির মতো ব্যাংক ভালো অবস্থায় আছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮-১০টি ব্যাংক একীভূত হতে পারে। এজন্য ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তবে গভর্নর এই আলোচনার সূত্রপাত করেছেন গত ডিসেম্বরে জারি করা ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ শীর্ষক নীতিমালার মাধ্যমে। ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হবে।
ওই নীতিমালা অনুযায়ী, মূলত পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর মান বা শ্রেণি নির্ধারণ করা হবে। সেগুলো হলো- ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ (সিআরএআর), টিয়ার-১ ক্যাপিটাল রেশিও বা মূলধন অনুপাত, কমন ইক্যুইটি টিয়ার-১ (সিইটি১) রেশিও, নিট খেলাপি ঋণ এবং করপোরেট গভর্নেন্স বা সুশাসন। পাঁচ সূচকে লাগাতার পতন হলে সব শ্রেণির ব্যাংককে ‘অনিরাপদ’ ও ‘আর্থিকভাবে অস্বাস্থ্যকর বা দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরপর দুই ক্যাটাগরিতে অবনতি হলে সবচেয়ে ‘দুর্বল’ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। দুর্বলতা কাটিয়ে ব্যাংকের মানোন্নয়নে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে কোনো ব্যাংককে একীভূত করার পদক্ষেপ নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে এই নীতিমালা অনুযায়ী একীভূত হওয়ার বিষয়ে আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক একীভূত করতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং কাজ শুরু করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, নিজেরা নিজেদের সবল করতে না পারলে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোর একটি সুরাহা করাই হচ্ছে একীভূত করার মূল উদ্দেশ্য। প্রশ্ন হচ্ছে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে খুঁজে বের করতে মডেল কী হবে, তার ওপরে নির্ভর করবে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে কোনো দুর্বল প্রতিষ্ঠান থাকলে পুরো খাতই ঝুঁঁকির মধ্যে থাকে। এই ঝুঁকি এড়ানোর একটা অন্যতম ব্যবস্থা হচ্ছে একীভূত করা। তবে এটা সহজ কাজ নয়। কারণ দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ ও দেনা দুই-ই আছে। মূলধন ঘাটতি আছে। তাই একীভূত করতে সক্ষম ব্যাংককে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। যদি কেউ আগ্রহ প্রকাশ করে এগিয়ে আসে তবে তার কারণও খুঁজে দেখতে হবে।
এর আগে ২০১৯ সালেও ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। দুর্বল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বাধ্যতামূলকভাবে একে অপরের সঙ্গে একীভূত হতে পারে, সেজন্য একটি সুনির্দিষ্ট মার্জার নীতিমালা তৈরি করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ড. মো. কবির আহমদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ এবং অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই কমিটি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের কাছে দাখিল করবে। কিন্তু পরবর্তীতে তা আর কাজে আসেনি।
বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী বলেন, ব্যাংকগুলো নিজে থেকে এগিয়ে না এলে জোর করে একীভূত করে দেয়ার ফল ভালো নাও হতে পারে। শক্তিশালী ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে চাইবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মালিক যেহেতু সরকার। এই ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে।

source: bhorerkagoj.com

 

weak bank industry company sharemarket Bangladesh bank bb

You may also like