শেয়ারবাজারের ওটিসিতে থাকা কোম্পানিটির কয়েক লাখ শেয়ার কিনে ইস্যু করা হয় নতুন শেয়ার। এখন চেষ্টা নিয়মিত লেনদেনে ফেরানোর।
শেয়ারবাজারে এখন কদর বেশি বন্ধ কোম্পানির। কারণ, এ ধরনের কোম্পানিকে ঘিরে বাজারে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ এক কারসাজি চক্র। তেমনি এক বন্ধ কোম্পানি রাঙামাটি ফুড প্রোডাক্টস নিয়ে নজিরবিহীন কারসাজি ও আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।
২০০৩ সাল থেকে কোম্পানিটির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসিতে তালিকাভুক্ত। ওটিসিতে কোম্পানিটির শেয়ারের তেমন লেনদেন হয় না। তাই কোম্পানিটি কিনে নিয়ে সেটিকে এসএমই বোর্ডে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও ডিএসই এর মধ্যে সেই আবেদন বাতিল করে দিয়েছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বন্ধ কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচায় একটি ‘ব্রোকার গ্রুপ বা দালাল চক্র’ গড়ে উঠেছে। এমনই এক দালাল চক্রের মাধ্যমে বন্ধ কোম্পানি রাঙামাটি ফুড প্রোডাক্টসের সঙ্গে যুক্ত হয় এক্সপো গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তারা কোম্পানিটির প্রকৃত উদ্যোক্তাদের শেয়ারের পুরোটা (১০ লাখ শেয়ার) কিনে নেয় প্রায় এক কোটি টাকায়। সঙ্গে ব্যাংকের দায়দেনার ভারও নেয়। এরপর মালিকানা হাতবদল হয়ে চলে আসে এক্সপো গ্রুপের কাছে। এরপরই ঘটে রাঙামাটি ফুডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি ও নানা অনিয়ম।
ডিএসইর তদন্ত ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে রাঙামাটি ফুড প্রোডাক্টস নিয়ে বড় ধরনের যেসব অনিয়ম পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে টাকা ছাড়া নতুন শেয়ার ইস্যু, ভুয়া কাজ দেখিয়ে অর্থ খরচ, যন্ত্রপাতি কেনার ভুয়া বিল তৈরি, জনবল ও পরামর্শককে ভুয়া বেতন প্রদানসহ আর্থিক নানা অনিয়ম।
একাধিক সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা যায়, মালিকানা হাতবদলের পর রাঙামাটি ফুডের নতুন ৪ কোটি শেয়ার (১০ টাকা অভিহিত মূল্যের হিসাবে যার দাম ৪০ কোটি টাকা) ইস্যু করা হয় গুটিকয়েক সুবিধাভোগীর মধ্যে। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শেয়ার নেয় এক্সপো গ্রুপের মালিক ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বাকি ২ কোটি ৮০ লাখ শেয়ার প্রায় ২০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়। ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রির এ ঘটনা ঘটে। তাতে মাত্র ৩ কোটি পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির মূলধন বেড়ে হয় ৪৩ কোটি টাকা। নতুন শেয়ার ইস্যুর পর কোম্পানিটিকে ওটিসি থেকে এসএমই বোর্ডে (ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের আলাদা প্ল্যাটফর্ম) স্থানান্তরের জন্য কারখানাও চালু করা হয়।
“বর্তমানে শেয়ারবাজারে যেসব কার্যক্রম চলছে, তাতে প্রয়োজনে সরকারের দিক থেকে বিএসইসির সামগ্রিক কার্যক্রমই তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। “
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি
জানা যায়, ২০২১ সালের মার্চে রাঙামাটির কাউখালীর চিনিকল এলাকায় অবস্থিত কোম্পানিটির মালিকানা হাতবদল হয়। এরপর ওই বছরের আগস্টে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানিটিকে ওটিসি থেকে এসএমই বোর্ডে স্থানান্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। আর কোম্পানিটি চলতি বছরের আগস্টে এসএমই বোর্ডে স্থানান্তরের জন্য ডিএসইতে আবেদন করে। এরপর ডিএসই কোম্পানিটির কার্যক্রম তদন্তের উদ্যোগ নেয়। সেই তদন্তে বেরিয়ে আসে নানা অনিয়মের চিত্র। সম্প্রতি এ তদন্ত প্রতিবেদন বিএসইসিতে জমা দেয় ডিএসই।
সেই তদন্তে উঠে আসা কোম্পানিটির নানা অনিয়মের তথ্য বিএসইসি সূত্রে হাতে আসে প্রথম আলোর। এরপর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় জানা যায়, বন্ধ কোম্পানিকে ঘিরে বাজারে গড়ে উঠেছে এক ‘দালাল চক্র’। যাদের কাজ হচ্ছে বন্ধ কোম্পানির মালিকানা বা শেয়ারের কেনাবেচার ব্যবস্থা করে দেওয়া। বিনিময়ে তারা কখনো নগদ কমিশন নেয়, আবার কখনো শেয়ার নেয়। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত বিএসইসিরও একটি অংশ। ফলে সহজে অভিনব সব পন্থায় বন্ধ কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করে বাজার থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে কারসাজিকারকেরা।
নিয়ম অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি নতুন শেয়ার ইস্যু করতে গেলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু রাঙামাটি ফুড ৪ কোটি শেয়ার ইস্যু করেছে কোনো অনুমোদন ছাড়াই।
গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে কথা হয় রাঙামাটি ফুডের মালিকানায় যুক্ত হওয়া এক্সপো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে। মতিঝিলে এক্সপো গ্রুপের কার্যালয়ে আলাপকালে এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি বলেন, ‘তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়ায় নতুন শেয়ার ইস্যুর ক্ষেত্রে অনুমোদনের দরকার হয় না বলে বিএসইসি আমাদের জানিয়েছে।’
রাঙামাটি ফুড নতুন শেয়ার ইস্যু করেছে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। প্লেসমেন্টে এক্সপো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে যেসব শেয়ার কেনা হয়েছে, সেগুলোর বিপরীতে প্রকৃত অর্থে কোনো অর্থ জমা হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারবাজারের কোনো কোম্পানি শেয়ার ইস্যু করে মূলধন সংগ্রহ করলে সে ক্ষেত্রে সংগ্রহ করা অর্থ কোথায় খরচ করা হবে বা হয়েছে এবং তাতে কোম্পানির লাভ কতটুকু ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানাতে হয়।
টাকা ছাড়াই শেয়ার ইস্যু
একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এক্সপো গ্রুপ তাদের নিজেদের বাইরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করে যে টাকা পেয়েছে, সেই অর্থই আবার নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানির নামে ইস্যু করা শেয়ারের দাম (শেয়ার মানি) হিসেবে দেখিয়েছে।
বিষয়টি এমন, ধরা যাক কোম্পানিটি একজন বিনিয়োগকারীর কাছে শেয়ার বিক্রি করে এক কোটি টাকা পেয়েছে। সেই টাকা কখনো নগদে ও কখনো ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়েছে। সেই টাকা আবার এক্সপো গ্রুপের স্বত্বাধিকারী ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তিশ্রেণির কিছু বিনিয়োগকারীর কাছে শেয়ার বিক্রি করে পাওয়া অর্থের একটি অংশ ঘুরেফিরে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে এক্সপো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে ইস্যু করা শেয়ারের মূল্য বা শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসেবে।
এ জন্য দেখা যায়, রাঙামাটি ফুডের শেয়ার বিক্রি বাবদ কোম্পানিটির ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমার পর সেই টাকা তুলে নিয়েছে এক্সপো গ্রুপ। আবার সমপরিমাণ অর্থ এক্সপো গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে রাঙামাটি ফুডের ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়েছে।
বিএসইসি, ডিএসই সংশ্লিষ্ট ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের কার্যক্রম আর্থিক জালিয়াতি। সিকিউরিটিজ আইনের পাশাপাশি অর্থ পাচারসংক্রান্ত আইনেরও লঙ্ঘন। এ কারণে এক্সপো গ্রুপের এ ধরনের জালিয়াতিকে অত্যন্ত সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ডিএসইর তদন্তে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন নয়, এটি ফৌজদারি অপরাধের পাশাপাশি অর্থ পাচার আইনের লঙ্ঘন। তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বিএসইসি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ থেকে গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। তদন্তে অনিয়ম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট সব আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। অন্যথায় এ ধরনের অভিনব জালিয়াতি আরও ঘটতে থাকবে।
ভূমি উন্নয়নের নামে ভুয়া বিল
রাঙামাটি ফুড নতুন শেয়ার ইস্যু করে যে অর্থ পেয়েছে, তার মধ্যে ৪ কোটি টাকার বেশি ভূমি উন্নয়নে খরচ দেখানো হয়। কিন্তু ডিএসইর তদন্ত দল সংশ্লিষ্ট লেনদেনের ব্যাংক হিসাব বিবরণী পর্যালোচনায় দেখতে পায়, ভূমি উন্নয়ন বাবদ সামিহা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। কিন্তু সামিহা এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাবে ওই অর্থ জমার পরপরই তা তুলে নেন রাঙামাটি ফুডের এক কর্মকর্তা। ৪ কোটি টাকার মধ্যে বাকি ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা সামিহা এন্টারপ্রাইজকে নগদে পরিশোধ করা হয়। নগদে বিল পরিশোধের এ তথ্যও ভুয়া বলে ডিএসইর তদন্তে দাবি করা হয়। একই ধরনের আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে পূর্ত কাজ, যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, কর্মীদের বেতন–ভাতা, পরামর্শক মাশুল প্রদানসহ আর্থিক নানা লেনদেনে। নতুন শেয়ার কোম্পানিটি সংগ্রহ করা ৪০ কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ দেখানো হলেও তার বিপরীতে কোনো কর-ভ্যাটই প্রদান করেনি। ডিএসই বলছে, আয়কর আইনেরও লঙ্ঘন।
“কোম্পানিটি বন্ধ থাকায় একপর্যায়ে সেটিকে তালিকাচ্যুত করে ওটিসিতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির মূলধন বৃদ্ধিতে আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল না, বিএসইসি থেকে তাদের সেটি জানানো হয়েছিল। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বন্ধ কোম্পানিটি চালুর জন্য একজন উদ্যোক্তা উদ্যোগ নেন, বিএসইসি তাতে সহায়তা করেছে।”
মোহাম্মদ রেজাউল করিম, মুখপাত্র বিএসইসি ও নির্বাহী পরিচালক
কেন বন্ধ কোম্পানিতে এত আগ্রহ
শেয়ারবাজারে বর্তমানে বন্ধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে একটি গোষ্ঠী বেশ সক্রিয়। সেটি সেকেন্ডারি বাজারের পাশাপাশি ওটিসি বাজারে থাকা কোম্পানির ক্ষেত্রেও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্ধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে এই আগ্রহ তৈরি হয় বিএসইসির বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক বছর পর থেকে। ২০২০ সালে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু বন্ধ কোম্পানি চালুর উদ্যোগ নেয়। এ জন্য এসব কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করা হয়। আর বিএসইসির এ উদ্যোগকে পুঁজি করে শুরু হয় নানা ধরনের কারসাজি। এ জন্য কিছু উদ্যোক্তা ও কারসাজিকারক মিলে গড়ে ওঠে একটি চক্র।
জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানিটি বন্ধ থাকায় একপর্যায়ে সেটিকে তালিকাচ্যুত করে ওটিসিতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির মূলধন বৃদ্ধিতে আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল না, বিএসইসি থেকে তাদের সেটি জানানো হয়েছিল। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বন্ধ কোম্পানিটি চালুর জন্য একজন উদ্যোক্তা উদ্যোগ নেন, বিএসইসি তাতে সহায়তা করেছে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে যেসব কার্যক্রম চলছে, তাতে প্রয়োজনে সরকারের দিক থেকে বিএসইসির সামগ্রিক কার্যক্রমই তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তা না হলে শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো খুব কঠিন হবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো
closed company bondho dse cse stockmarket sharebazar