ডলার সংকটে দেশের বস্ত্র খাত এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। চাহিদা অনুযায়ী ডলার না পাওয়ায় এ খাতের উদ্যোক্তারা কাঁচামাল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছেন না।
এমনকি মেরামতের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করতেও সমস্যা হচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট তো আছেই। এরফলে রপ্তানিমুখী বস্ত্র খাতসহ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়ে বস্ত্র মিলগুলোতে উৎপাদন কমিয়ে দিতে হচ্ছে।
এতে একদিকে উৎপাদন ব্যয় যেমন বেড়ে গেছে, অন্যদিকে কাঁচামাল সংকটের কারণে মিলগুলো পুরোদমে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সঙ্গত কারণে এ সেক্টরে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেকার হতে পারেন হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী।
পরিস্থিতি সেদিকে গড়ালে বস্ত্র খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ঋণ বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সদিচ্ছা থাকলেও অনেকে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে পারবেন না।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক মাসুদ রানা বলেন, ‘কিছু ব্যাংক রপ্তানিমুখী শিল্পের এলসি খুলতে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করছে। শিল্পের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৩০-৫০ শতাংশ এলসি খোলা হচ্ছে। অর্থাৎ কারখানায় ১০০ টাকা কাঁচামাল লাগলে ৩০-৫০ টাকার এলসি খোলা হচ্ছে। এতে মেশিনের সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করা যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল ছাড়া যেসব মিল তুলা আমদানি করে সুতা বানিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে তাদের এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের মিলের এলসি এখন প্রায় বন্ধ আছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বস্ত্র খাতের রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। একই সময়ে কাঁচামালের আমদানিও কমেছে ২ শতাংশ। এলসি খোলা কমে যাওয়ায় আগামীতে এসব খাতের কাঁচামাল আমদানিও কমে যেতে পারে।
অথচ গত অর্থবছরে রপ্তানিমুখী বস্ত্র খাতের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা বেড়েছিল ৪০ শতাংশ ও আমদানি বেড়েছিল ৫৭ শতাংশ। এর পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। ডলারের জোগান না থাকায় উদ্যোক্তারা ব্যাংকে গিয়েও এলসি খুলতে পারছেন না।
ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ৬৬৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয় ৪৪৯ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের। এ সময়ে এলসি খোলা কমেছে ৩২ দশমিক ৮২ শতাংশ।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এসব খাতের কাঁচামাল আমদানি করা হয় ৫৪২ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি করা হয় ৫৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। এ সময়ে আমদানি কমেছে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রপ্তানিমুখী ও বাণিজ্যিকভাবে কাপড় আমদানির এলসি খোলা কমেছে ২৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। প্রাইমারি টেক্সটাইলের প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। প্লাস্টিকের তৈরি সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৬২ দশমিক ৭২ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ২৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। সিনথেটিক ফাইবার ও ইয়ার্ন আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এদিকে এ খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বস্ত্র খাতের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে ব্যাংক গড়িমসি করছে। ব্রাঞ্চে এলসি খোলার আবেদন করলে তা অনুমোদনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এ কারণে ১০-১৫ দিনের বেশি সময় লাগছে এলসি খুলতে। আবার ক্ষেত্র বিশেষে মাস খানেকও লাগছে। সংকট এতটাই ভয়াবহ যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
শিল্প মালিকরা বলছেন, বর্তমানে শুধু রপ্তানিমুখী বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব রপ্তানি আয়ের ডলার দিয়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলতে পারছে। তারা পণ্য রপ্তানি করে সেই ডলার দিয়েই এলসি খুলছেন। তবে আগে এলসি খুললে যেমন দ্রুত সব প্রক্রিয়া শেষ হতো, এখন সেটি হচ্ছে না। কমপক্ষে ১৫-২০ দিন বিলম্ব হচ্ছে। এতে করে অনেক সময় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
অপরদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এ কারণে রপ্তানি আয় দিয়ে স্থানীয় খরচ মেটানোর পর যে ডলার থাকছে তা দিয়েও কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না। আরও বাড়তি ডলার লাগছে। এর বাইরে যারা ডলার আয় করতে পারছেন না, তাদের এলসি খোলার সম্ভাবনা খুবই কম। আবার যাদের ডলার আয় কম, কিন্তু এলসি খোলার পরিমাণ বেশি; তারাও এলসি খুলতে পারছেন না।
ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা স্বীকার না করলেও পুরো বস্ত্র খাত ডলার সংকটের কারণে এ রকম বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে রপ্তানি খাতে আরও বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোশাররফ কম্পোজিট টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রাইমারি টেক্সটাইলের (তুলা থেকে সুতা বানিয়ে একেবারে কাপড় তৈরি করা পর্যন্ত কম্পোজিট মিল) শিল্প মালিকরা চতুর্মুখী সংকটে আছেন। ডলার থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে বিলম্ব করছে। অন্যদিকে রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ায় সুতার চাহিদাও কমে গেছে। চাহিদা কমায় তুলার দামের চাইতে কম দামে সুতা বিক্রি করতে হচ্ছে। শ্রমিক মজুরি, জ্বালানি খরচসহ প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে ৪ ডলার খরচ হয়, সেই সুতা বিক্রি করতে হচ্ছে ৩ ডলার ১০ সেন্টে।
বর্তমানে ৮০ ভাগ মিল মালিক লোকসান দিয়ে সুতা বিক্রি করছেন। নতুন তুলার দাম কিছুটা সহনীয়। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে তুলার অর্ডার দেওয়া যাচ্ছে না। সামনের দিনগুলোতে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’
লিটল স্টার স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, ‘বর্তমানে এলসি খুলতে খুব দেরি হচ্ছে। দেড় মাস আগে আবেদন করে গতকাল (মঙ্গলবার) এলসি পেয়েছি। ব্যাংকভেদে ১৫-২০ দিন সময় লাগছে। এতে বস্ত্র খাতের শিল্প মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাইমারি টেক্সটাইল মালিকদের তুলার আমদানিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। কারণ সময়মতো তুলার এলসি খুলতে না পারলে দেড় শতাংশ লেট ফি (ক্যারিং চার্জ) কাটা হয়। এ ধারা চলতে থাকলে শিল্প মালিকদের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তখন ডলার থাকলেও তুলা আমদানি করা সম্ভব হবে না।’