দেশে কেটিএম ও এপ্রিলা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল নিয়ে এসে ক্রেতাদের মাঝে সাড়া ফেলে দিয়েছিল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রানার অটোমোবাইলস পিএলসি। তরুণদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বাইকগুলো। একপর্যায়ে বিদেশেও রফতানি করে কোম্পানিটি। একসময়ের সাড়া জাগানো কোম্পানিটি এখন ব্যবসায়িক ও আর্থিকভাবে খারাপ সময় পার করছে। দুই বছর ধরেই লোকসান গুনছে কোম্পানিটি। গত হিসাব বছরে (২০২২-২৩) ব্যবসা কমেছে ৪০ শতাংশ। কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে ২১ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
আর্থিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে রানার অটোমোবাইলস এখন রুগ্ণ হয়ে পড়ছে বলে আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। ব্যবসায়িক পরিস্থিতির দিক থেকে খারাপ সময় যাচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন কোম্পানির কর্মকর্তারাও। এজন্য দায়ী করছেন প্রধানত ডলার সংকট ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে আসাকে। বর্তমানে থ্রি হুইলার ও ইলেকট্রিক ভেহিকল দিয়ে কোম্পানিটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন তারা।
রানার গ্রুপের ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি রানার অটোমোবাইলসের যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালে। এ বছরই দায়াং বাইক বিক্রি শুরু করে কোম্পানিটি। ময়মনসিংহের ভালুকায় গড়ে তোলা হয় কারখানা। যেখানে বার্ষিক এক লাখ পিস মোটরসাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ২০০৯ সালে বাইক সংযোজন এবং ২০১২ সালে বাইক উৎপাদন কারখানা চালু করে। ২০১৭ সালে রানার অটোমোবাইলস প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে নেপালে মোটরসাইকেল রফতানি শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ভুটানেও রফতানি শুরু হয়। দুই দেশেই তাদের শোরুম রয়েছে। দেশের বাজারে ৮০ থেকে ১৬৫ সিসি সক্ষমতার মোটরসাইকেল বিক্রি করছে কোম্পানিটি। আর বিদেশে রফতানীকৃত মোটরসাইকেল ২০০ সিসি সক্ষমতার। সরকারের কাছ থেকে কোম্পানিটি ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল উৎপাদনের অনুমোদন পেয়েছে।
মোটরসাইকেলের পাশাপাশি এলপিজি ও ডিজেলচালিত থ্রি-হুইলার উৎপাদন করছে রানার অটোমোবাইলস। এছাড়া আইশার ব্র্যান্ডের ট্রাক, পিকআপ ও ট্রাক্টরও বাজারজাত করছে। কোম্পানিটি বর্তমানে বেশ কয়েকটি মডেলের ইলেকট্রিক স্কুটারও বাজারে এনেছে। মূলত ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় এ ধরনের গাড়ির চাহিদা রয়েছে দেশে। পাশাপাশি অটোমোবাইল ও মেকানিক্যাল পণ্যের ব্যবসাও রয়েছে। অবশ্য সর্বশেষ হিসাব বছরে সীমিত পরিসরে এ ব্যবসা চালু ছিল বলে জানিয়েছেন কোম্পানির নিরীক্ষক।
২০১৯ সালে রানার অটোমোবাইলস দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। সেই সময় পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ১০০ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করে তারা। আইপিওর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ যন্ত্রপাতি ক্রয়, গবেষণা ও উন্নয়ন, ঋণ পরিশোধ এবং আইপিও প্রক্রিয়ার খরচ খাতে ব্যয় করেছে কোম্পানিটি। পুঁজিবাজারে আসার তিন বছর পরেই ব্যবসায়িকভাবে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে রানার অটোমোবাইলস। টানা দুই হিসাব বছর ধরে গুনতে হচ্ছে লোকসান। গত হিসাব বছরে এর আগের হিসাব বছরের তুলনায় কোম্পানিটির প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার ব্যবসা কমেছে।
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির গত পাঁচ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ব্যবসা থেকে আয় হয়েছিল ১ হাজার ১১৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আলোচ্য হিসাব বছরে ৬৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছিল। এর পরের ২০১৯-২০ হিসাব বছরে কোম্পানিটির আয় হয় ৯৪৬ কোটি ৪৯ লাখ এবং নিট মুনাফা ছিল ৩৪ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০২০-২১ হিসাব বছরে রানার অটোমোবাইলসের আয় ১ হাজার ১৪ কোটি ১৮ লাখ এবং নিট মুনাফা ছিল ৪৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০২১-২২ হিসাব বছরে আয় হয়েছিল ১ হাজার ১১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আলোচ্য বছরে কোম্পানিটি প্রথমবারের মতো ২৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা লোকসান গুনেছিল। সর্বশেষ ২০২২-২৩ হিসাব বছরে রানার অটোমোবাইলসের আয় হয়েছে ৬৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। মোটরসাইকেল, থ্রি-হুইলার ও ট্রাক বিক্রি কমে যাওয়ায় এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় কমেছে ৪০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আলোচ্য হিসাব বছরে রানার অটোমোবাইলসের ২১ কোটি ২৯ লাখ টাকা কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে।
রানার অটোমোবাইলসের সংরক্ষিত আয় ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ২১৬ কোটি ১৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর আগের ২০২১-২২ হিসাব বছরে যা ছিল ৩১০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় কমেছে ৯৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ হিসাব বছরে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৯৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর আগের হিসাব বছরে ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬০২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ঋণের সুদ ও আর্থিক ব্যয় বাবদ ২০২২-২৩ হিসাব বছরে ১৪১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে কোম্পানিটির। যেখানে আগের ২০২১-২২ হিসাব বছরে এ খাতে খরচ হয়েছিল ১৩১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে আয় কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে কোম্পানিটি স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে, টু-হুইলার, থ্রি-হুইলার এবং বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় আয় কমে গেছে। যে কারণে এ সময়ে তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে। কোম্পানিটির কর্মকর্তাদের দাবি, ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত হওয়ায় কোম্পানিটির পণ্য বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে।
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) সনৎ দত্ত বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত হিসাব বছরে আমরা চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করতে পারিনি। এর কারণ হচ্ছে ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব হয়নি। আমাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো সাধারণত বিলাসপণ্যের আওতায় পড়ে। ডলার সংকটের কারণে সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এক্ষেত্রে ডলারের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে বিলাসপণ্য উৎপাদকদের অগ্রাধিকার অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদকদের তুলনায় কম। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে গেছে, এতে পণ্যের দামও বেড়েছে। আমাদের গ্রাহক মূলত নিম্নমধ্য ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির প্রভাবে এ দুই শ্রেণীর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে আমাদের ব্যবসায়। সব মিলিয়ে বলা যায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক—এই দুই কারণে সর্বশেষ হিসাব বছরে কোম্পানির ব্যবসা ও মুনাফায় প্রভাব পড়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি থ্রি-হুইলার ও ইলেকট্রিক ভেহিকলের মাধ্যমে ব্যবসায়িকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর।’
রানার অটোমোবাইলসের ব্যবসায়িক অবস্থা ও সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাড়া পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুবীর কুমার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
Runner loss
Source: https://bonikbarta.net/