Home Finance বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন বলছেন, অর্থনীতি তলানিতে

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন বলছেন, অর্থনীতি তলানিতে

by fstcap

CSE DSE Stockmarket Sharebazar Pujibazar taka stockholder investor

মূল্যস্ফীতি যেন না বাড়ে, সে জন্য দীর্ঘদিন ডলারের দর বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাতে ফল হয়েছে উল্টো। একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, অপরদিকে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরাও পাচ্ছেন না ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়োগ করা মুদ্রানীতির কোনও সূত্রই যেন এ ক্ষেত্রে কাজ করছে না।

শুধু তা-ই নয়, ডলার সংকটের কারণে টান পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কমে এখন ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের কাছ থেকে ১২৪ টাকা দিয়ে ডলার কিনে আমদানিকারকদের কাছে ১২৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। এতে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পরিস্থিতি উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার পরামর্শ নিচ্ছেন দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় সাবেক গভর্নর, বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈঠকগুলোতে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে সেই মোতাবেক করণীয়গুলো জেনে নিচ্ছেন গভর্নর। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির ক্ষতটা কতটা গভীরে নেমেছে, তাও তিনি তুলে ধরছেন কোনও কোনও বৈঠকে।

সোমবার (৬ নভেম্বর) অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নেতাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় আব্দুর রউফ তালুকদার অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জ এবং এগুলোর মোকাবিলায় গৃহীত নানা ব্যবস্থা ও অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা বর্তমানে একেবারে তলানিতে এসেছি। আর তো নিচে নামার পথ নেই।’

‘দেশের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার ৩৬ বছরের সিভিল ও পাবলিক সার্ভিসে কখনোই এমন অর্থনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিনি। আমার কর্মজীবনে দুই ধরনের ঘাটতি দেখেছি; তা হচ্ছে— চলতি হিসাবের ঘাটতি ও রাজস্ব ঘাটতি। একই সঙ্গে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি হতে কখনোই দেখিনি।’

ইআরএফের সভায় আব্দুর রউফ তালুকদার স্বীকার করে বলেন, ‘পণ্যমূল্য বাড়ানোর নেপথ্যে সিন্ডিকেট হচ্ছে। সে জন্য অযৌক্তিকভাবে কোনও কোনও পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও সেগুলোর দামও বাড়ছে। সে জন্য মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এর মাধ্যমে ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান‌ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তলানিতে ঠেকেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।’

সচরাচর এই ধরনের স্বীকৃতি মেলে না বলে অনেক সমস্যার সমাধান হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সমস্যা সমাধানের জন্য গভর্নরের এই স্বীকৃতিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ব্যাপক ইতিবাচক দিক আছে। এ ছাড়া অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে দেশের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গেও গভর্নর সময় দিচ্ছেন। কোনও কোনও অর্থনীতিবিদের সঙ্গে গভর্নর ও তার সহকর্মীরা তিন ঘণ্টা, সাড়ে তিন ঘণ্টা বসে আলাপ করছেন। এই আলাপচারিতার মধ্যেই উঠে আসছে প্রকৃত সমস্যা বা গলদ কোথায়। অর্থনীতিবিদরাও সমস্যার কথা শুনে সেই অনুযায়ী পরামর্শ দিচ্ছেন। এখন দেখার বিষয় অর্থনীতিবিদদের পরামর্শগুলো যথাযথভাবে যথাসময়ে প্রয়োগ হয় কিনা।’

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেহেতু সবকিছুই দেখতে পারেন, সেহেতু তিনি অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র অনুধাবন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু তিনি স্বীকার করছেন, অর্থনীতি তলানিতে নেমেছে, সেহেতু আমরা আশা করবো নিশ্চয়ই তিনি সেই অনুযায়ী এখন ব্যবস্থা নেবেন।’

ইআরএফের সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচন-পরবর্তী যে স্থিতিশীলতা আসবে, তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। তাতে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়বে। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎস থেকেও বাড়তি অর্থায়ন সুবিধা পাওয়া যাবে।’

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান গভর্নর। তিনি আশা করেন ডিসেম্বর থেকে এ চাপও কমে আসবে।

তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আগে যে অস্থিরতা ছিল, তা অনেকটা কমে গেছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে তিনি দৃঢ় আশা করেন। সব মিলিয়ে অর্থনীতির চলমান সংকটের মধ্যে ‘টানেলের শেষ মাথায় আলো’ দেখছেন বলেও অভিমত প্রকাশ করেন গভর্নর।

তিনি মনে করেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে ও আগামী জুনের মধ্যে তা সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে। বিনিময় হারও এর মধ্যে ঠিক হয়ে আসবে। সেটি হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। এ ছাড়া টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে, ব্যাংকের সুদের হারও বাড়ছে। বাজারে টাকার সরবরাহ কমাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

তবে তিনি অর্থনীতিবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির প্রভাব নিয়ে তিনি চিন্তিত। তার মতে, অর্থনীতির কারণের পাশাপাশি অর্থনীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডও মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

গভর্নর আরও বলেন, ‘আমরা সব সময় জোড়া ঘাটতি নিয়ে আলোচনা করেছি– চলতি হিসাবের ঘাটতি ও রাজস্ব ঘাটতি। গত অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি এবং আর্থিক হিসাবের ঘাটতি উভয়ই দেখা গেছে, গত ১৪ থেকে ১৫ বছরেও যা ঘটেনি। আর্থিক অ্যাকাউন্টটি আগের অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত থেকে চলতি অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ঘাটতিতে পড়েছে। অর্থাৎ ১৭ বিলিয়ন ডলারের একটি ব্যবধান। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ব্যাপক মাত্রার পরিবর্তন আর দেখা যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করায় বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে। পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি ক্রেডিট ও ট্রেড ক্রেডিটও প্রতিকূল এবং আমাদের বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড় তিন বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।’

গভর্নর আরও বলেন, ‘এই চারটি বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যা আমাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।’

সভায় সাংবাদিক নেতাদের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, প্রবাসী আয়ের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে হুন্ডিতে। এ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘হুন্ডির চেয়ে ব্যবসার আড়ালে ১০ গুণ বেশি অর্থ পাচার হয়। ১০০ ডলারের পণ্য আনতে ৩০০ ডলার পাঠানো হয়েছে। অর্থ পাচার খুবই খারাপ আকার ধারণ করেছিল। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার বন্ধ করা হয়েছে। সব ধরনের ঋণপত্রের মূল্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। দেশ থেকে আগে প্রতি মাসে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হতো।’ কঠোর তদারকির ফলে এখন তা কমে এসেছে বলেও দাবি করেন তিনি।

সভায় ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে স্বীকার করে এই পরিস্থিতি বেশ নাজুক উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, ‘আমি গভর্নর হওয়ার পর ঋণ পুনর্নির্ধারণের একটি সীমা আরোপ করেছিলাম। আগে কোনও ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই পাঁচ থেকে ছয়বার ঋণ পুনর্নির্ধারণ করা যেত। আমি এটি চারবারে সীমিত করেছি। কোনও ঋণ চারবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যাবে না। এরপর তা ননপারফর্মিং লোনে পরিণত হবে এবং ব্যাংক মামলা করবে। সে কারণেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে।’

গভর্নর জানান, ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এখন থেকে আর ‘রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার’ পাবে না। তিনি এ তালিকায় কোনও ঋণখেলাপিকে দেখতে চান না, তা তিনি যত প্রভাবশালীই হোন না কেন।

আব্দুর রউফ তালুকদার মনে করেন, নানা কারণে আগের বছরের তুলনায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণজনিত সতর্কতার কারণে এমনটি হয়েছে। এর বাইরে জাতীয় নির্বাচনের কারণে উন্নয়ন-সহযোগীদের ঋণ ও অনুদানের অর্থ ছাড় করার পরিমাণও অনেক কমে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাদের অর্থছাড় উভয় পক্ষ স্বীকৃত বিভিন্ন শর্তের বাস্তবায়নের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে এসে তারাও তাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন, যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক ও কঠোর হয়েছেন।

গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংকে ঋণ আমানতের সুদের হারে যে ফ্লোর (সর্বোচ্চ সীমা, যা নয়ছয় নামে পরিচিতি পেয়েছিল) আরোপ করা হয়েছিল, তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমান বাজারভিত্তিক সুদ হার ব্যবস্থা চলছে। এর ফলে অচিরেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
banglatribune.com

You may also like