সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই উঠে আসছে দেশের অর্থনীতির খবরাখবর। হচ্ছে নানা ধরনের বিশ্লেষণ। তবে অনেকটা নেতিবাচক ভাবেই উপস্থাপিত হচ্ছে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। মূলত কমে আসা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করেই ডালপালা মেলছে এসব খবর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের। আর এসব প্রচারণার উপসংহারে থাকছে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগাম আভাস। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, আসলে কি তাই?
অনেকটা গাণিতিক হলেও অর্থনীতি একটি জটিল বিষয়। তথাকথিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বদলে অর্থনীতির বিশ্লেষণ করা হয় তথ্য উপাত্ত ও পরিসংখ্যানের গাঁথুনির ওপর ভিত্তি করে। আর এর ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয় বিশ্বের সর্বজনগ্রাহ্য ও খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার দেয়া তথ্য-উপাত্তকে। যেসব প্রতিষ্ঠানের গবেষণার মান, তথ্যের নির্ভুলতা ও সুনাম রয়েছে যুগ যুগ ধরে। তাই অর্থনীতির যে কোন বর্ণনার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্য-উপাত্তই গ্রহণযোগ্য হয় সব মহলের কাছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপারে যখন বিভিন্ন মাধ্যমে গেল গেল রব, তখন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তার অবস্থান আসলে কোথায়, তা জানার আগ্রহ জাগতে পারে যে কোন সচেতন পাঠকের মনেই।
সত্যি কি ধ্বংসের মুখে এদেশের অর্থনীতি, না-কি বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়নের নজির রেখে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব অর্থনীতির উদীয়মান শক্তি? দেখে নেয়া যাক, এ দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কী বলছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। তাদের দেয়া ডাটা, তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
একটি দেশের অর্থনীতির হাল কী, তার অনেকটাই উঠে আসে তার বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে। অর্থাৎ একটি দেশের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে, নাকি সংকুচিত – তা বোঝা যায় তার জিডিপি প্রবৃদ্ধির অনুপাতে।
বিশ্বের অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্তের নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ-এর নাম সর্বাগ্রে। প্রতি ছয় মাস পরপর জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর পূর্বাভাস দিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক এ দাতা সংস্থাটি। যা ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক’ হিসেবে প্রকাশিত হয় আইএমএফ-এর ওয়েবসাইটে।
এ তো গেল আগামী ৫ বছরের পূর্বাভাস। আইএমএফ-এর গত ৫ বছরের তথ্য-উপাত্তের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, ২০১৮ থেকেই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বজায় ছিলো ছয় থেকে আট শতাংশের ঘরে, মাঝে শুধু ২০২০ সালে কোভিডের সময় বাদ দিয়ে।
এমনকি কোভিড মহামারির সময় যখন প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি সঙ্কোচনের শিকার হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। এ পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনসহ আরও অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদনে।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের অর্থনীতি বা জিডিপির আকার নিয়ে। একটি দেশের অর্থনীতি কত বড় তার ওপর নির্ভর করে দেশটির বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থানকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি বা জিডিপির আকারের ওপর বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য-উপাত্তকেই গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় সর্বত্র। বৈশ্বিক এ দাতা সংস্থার দেয়া দেয়া তথ্য-উপাত্তকে অগ্রাহ্য করতে পারে না তার সমালোচকরাও। দেখা যাক, তাদের দেয়া তথ্য-উপাত্তে কী অবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির!
বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়ায় ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৮ সালে যা ছিলো ৩২১ বিলিয়ন ডলার এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ঠিক আগের বছর ২০০৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিলো মাত্র ৯১ বিলিয়ন ডলার।
মাথাপিছু আয়ে এমনকি প্রতিবেশী ভারতকে বাংলাদেশ অতিক্রম করে ২০২১ সালে। সে সময় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিলো ২ হাজার ৪৫৭ ডলার। পক্ষান্তরে তখন ভারতের মাথাপিছু আয় ছিলো ২ হাজার ২৩৮ ডলার।
এ তো গেল বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক পরিস্থিতির চিত্র, যা উপস্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও নিরপেক্ষ সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী। এখন দেখা যাক, কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি। আর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের ব্যাপারে কী বলছে আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংক ও গবেষণা সংস্থাগুলো!
লন্ডনভিত্তিক বিশ্বের খ্যাতনামা অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ’দি ইকোনোমিস্ট’। যাদের অর্থনীতি বিষয়ক থিংকট্যাংক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ’ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’-এর দেয়া তথ্যমতে বর্তমান অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ বিশটি অর্থনৈতিক শক্তির কাতারে চলে আসবে বাংলাদেশের নাম।
ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অন্যান্য বেশ কিছু সেক্টরের সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি অর্থনীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বাংলাদেশকে।
এর আগে, গত বছরের শেষ নাগাদ অনুরূপ পূর্বাভাস দিয়েছিলো লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘দি সেন্টার ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ’ (সিইবিআর)। এ সংস্থা ২০৩৭ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের ২০তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলে পূর্বাভাস দেয় তাদের প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক লিগ টেবিল ২০২৩’ প্রতিবেদনে। সে সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ১ হাজার ৬২৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে বলেও পূর্বাভাস দেয়া হয় ওই প্রতিবেদনে।
আর মাত্র সাত বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে, বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের মতো বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক থিংকট্যাংকের পূর্বাভাস এটি। এছাড়া ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনৈতিক শক্তির একটিতে পরিণত হবে বাংলাদেশ, ‘ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’-এর এ পূর্বাভাসই নির্দেশ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যতকে।
মূলত ডলার সঙ্কটের মতো সাময়িক অর্থনৈতিক সঙ্কটকে পুঁজি করে দেশের অর্থনীতি রসাতলে যাওয়ার যে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে, তার যৌক্তিকতা কতখানি, সে বিষয়টি পরিষ্কার হয়, যখন সামনে আসে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ খ্যাতনামা ও নিরপেক্ষ সব আন্তর্জাতিক সংস্থার দেয়া সঠিক তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান।
source: somoynews