Home Banking বছর শেষে ব্যাংকে টাকার তীব্র সঙ্কট

বছর শেষে ব্যাংকে টাকার তীব্র সঙ্কট

by fstcap

বছরের হিসাব সমাপ্ত করতে ব্যাংকগুলোর হাতে সময় আছে আর মাত্র এক দিন। অর্থাৎ আজ বৃহস্পতিবার। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংককে টাকার সঙ্কট রেখেই এ বছরের হিসাব শেষ করতে হচ্ছে। তহবিল ঘাটতি মেটাতে শেষ সময়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নানা কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। যাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ আছে তারাও আন্তঃব্যাংকে টাকা ধার দিতে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে। এ কারণে আন্তঃব্যাংকে টাকার দাম বেড়ে গেছে। গতকাল ১৪ দিন মেয়াদের জন্য ধার নিতে ব্যাংকগুলোকে সার্বোচ্চ সাড়ে ১২ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। আন্তঃব্যাংকে টাকা না পেয়ে ছুটে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী টাকা ধার দিচ্ছে। গত কয়েক দিনের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০ ডিসেম্বর ২৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা, ২১ ডিসেম্বর ১৮ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা এবং ২৬ ডিসেম্বর টাকা ধার দেয়া হয়েছে ২০ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রতি ১০০ টাকার জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে পৌনে ৮ শতাংশ থেকে পৌনে ১০ শতাংশ সুদ।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলো তাদের সারা বছরের হিসাব সমাপ্ত করেন বছরের শেষ দিনগুলোতে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন গ্রাহককে ঋণ পরিশোধে চাপ প্রয়োগ করেন। কারণ খেলাপি ঋণ বেশি থাকলে বেশি পরিমাণ প্রভিশন রাখতে হয়। এ প্রভিশন রাখা হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। এতে কমে যায় ব্যাংকের মুনাফা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকে শীর্ষ নির্বাহী এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বড় বড় গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করছেন না। গতকাল এমন কয়েকটি গ্রাহককে অনুরোধ করা হয়েছে ঋণ পরিশোধে। এমনও বলা হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বরের আগে ঋণ পরিশোধ করলে জানুয়ারি মাসে তাদেরকে নতুন করে ঋণ দেয়া হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে ওই ব্যাংকের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিল করায় বার বার ছাড় দেয়ায় ঋণ পরিশোধে এক ধরনের ব্যবসায়ীর মধ্যে অনিহা দেখা দিয়েছে। তারা বছরের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের দিকে। এবারো ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ বণিক সমিতির ফেড়ারেশন বা এফবিসিসিআই থেকে এ ধরনের একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকরা প্রায় আট মাস যাবত তাদের বকেয়া পাওনা পাচ্ছেন না। প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এ কারণে তারা ডিসেম্বর শেষে ঋণ পরিশোধ থেকে ছাড় চেয়েছেন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গতকাল পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। আর এ কারণে ব্যাংকের নগদ আদায় কমে গেছে। নগদ আদায় কমে যাওয়ায় কোনো কোনো ব্যাংকের তহবিল সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে চলমান বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সঙ্কটের পাশাপাশি নগদ টাকারও সঙ্কট বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক (কলমানি মার্কেট) থেকে উচ্চ সুদে পর্যাপ্ত ধার না পাওয়ায় সঙ্কট মেটাতে কিছু কিছু ব্যাংক প্রতি দিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হচ্ছে। তহবিল সঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ উচ্চ সুদে ধার নিতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। আর এ তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় সমন্বয় করতে ঋণের সুদহারও বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। একে তো ডলারের উচ্চ মূল্যে আমদানি ব্যয় বাড়ছে এর ওপর ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পণ্য উৎপাদনে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে পণ্য মূল্য।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতোমধ্যে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার হার (রেপো) এক সাথে পৌনে ১ শতাংশ সুদ বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ স্বপক্ষে দাবি হলো বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর অন্যতম উপায় হলো নীতি সুদহার বাড়ানো। আর নীতি সুদহার বাড়ানো হলো ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়বে। আর এতে সব ধরনের ঋণের সুদহার বাড়বে। ঋণের সুদহার বাড়লে মানুষ কম ব্যয় করবে। এতে মূল্যস্ফীতি কমে যাবে। তবে, এর বিপক্ষে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এটা কার্যকর হয় রফতানি বেশি এমন উন্নত দেশগুলোর জন্য। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি তো আমদানি নির্ভর। রফতানির চেয়ে আমদানি হয় বেশি। যে টুকু রফতানি হয় এর একটি বড় অংশ আবার (তৈরী পোশাক) ব্যাক টু ব্যাক এলসির নামে বিদেশে চলে যায়। সুতরাং ঋণের সুদহার বাড়লে পরোক্ষভাবে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আর এ ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এতে মূল্যস্ফীতি কমে না বরং উসকে দেয়া হয়। একজন ব্যবসায়ী বলেন, ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদা অনুযায়ী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ডলার সংস্থান করতে পারছে না। অনেক সময় প্রতি ডলারের বিপরীতে বেশি ব্যয় করেও চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের এলসি খোলা যায় না। এতে তাদের উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এমনিতেই ডলার সঙ্কট এর ওপর ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি না কমে বরং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স ও রফতানির মাধ্যমে যে পরিমাণ ডলার আহরণ করা হচ্ছে চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে ডলারের দাম বাড়ছে। সিন্ডিকেট ও অতিমুনালোভীদের কারসাজির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো ডলারের দাম বৃদ্ধি। সবমিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ আগের মতো আর ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং অনেকেই মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির কারণে বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করতে জমানো টাকা খরচ করছে। এতে ব্যাংকে কাক্সিক্ষত হারে আমানত বাড়ছে না। আবার ডলার সঙ্কটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ অর্থে ডলার কিনতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৩৭৬ কোটি মার্কিন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়েছে সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে)। আবার শরিয়াভিত্তিক কিছু ব্যাংকের অনিয়মতান্ত্রিক ঋণ দেয়ার কারণে ওই ঋণ আর ফেরত আসছে না। গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) এক সাথে ৩৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সবমিলেই ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে আন্তঃব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয়া হচ্ছে। এতে কলমানি মার্কেটের সুদহারও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের ৪ অক্টোবর কলমানি মার্কেট থেকে ধার নিতে ৫.৭৯ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হতো, গত ২৭ সেপ্টেম্বর তা বেড়ে ৬.৬৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। গতকাল ২৮ ডিসেম্বর ১৪ দিন মেয়াদি তহবিল পেতে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে।

source: dailynayadiganta.com

 

money crisis bank end of year taka songkot 

You may also like