চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কারণে গত বছর বাড়তি দর দিয়েও ডলার মিলছিল না। দরও বেশ অস্থিতিশীল ছিল। ডলার ঘিরে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তবে নির্বাচনের পর অস্থিরতা কমেছে। উচ্চ দরে স্থিতিশীল হয়ে আছে ডলার। অনেক দিন ধরে ব্যাংকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ১২১ থেকে ১২২ টাকায় রেমিট্যান্স কিনছে। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করছে ১২২ থেকে ১২৪ টাকায়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার নির্ধারিত দর ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর বিক্রিতে ১১০ টাকা নির্ধারিত আছে। মূলত ধরে রাখা ডলার বাজারে আসতে শুরু করা, ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বদল না করা এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের ধারা অব্যাহত থাকায় বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য এখনও বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ডলার ছাড়ে অনীহা দেখাচ্ছে ব্যাংক। অনেকে স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে না পেরে বাধ্য হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থ নেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
ব্যাংকাররা জানান, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা অনিশ্চয়তার কারণে প্রবাসী কিংবা রপ্তানিকারকদের অনেকে ডলার ধরে রাখছিলেন। ডলারের দর বেড়ে ১৫০ টাকায় ঠেকবে– এমন গুঞ্জন ছিল বাজারে। যে কারণে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীদের একটি অংশ খরচ মেটাতে দেশে জমানো টাকা ভাঙিয়ে চলছিল। তবে গত ডিসেম্বর থেকে রেমিট্যান্স গ্রাহকের নামেও বৈদেশিক মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট খুলে ডলার রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। এর বিপরীতে সুদ মিলছে ৭ থেকে ৯ শতাংশের ওপরে। অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে দেশে অর্থ আনতে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আবার বিভিন্নভাবে রিজার্ভ বাড়ানোর মাধ্যমে বাজারে ইতিবাচক একটি বার্তা দিতে পেরেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থ পাচার রোধেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক সমকালকে বলেন, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে। আমদানি কম রয়েছে। আর্থিক হিসাবেও উন্নতি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খুলে অর্থ জমা, অফশোর ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন নীতিগত শিথিলতাও ভূমিকা রেখেছে। ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ ডলারের স্থিতিও বাড়ছে।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যাংকার জানান, বৈশ্বিক সুদ অনেক বাড়লেও দেশে গত জুন পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সীমা ছিল। এ কারণে দেশে সঞ্চয় করে তেমন সুদ না পাওয়ায় অনেকে নিরুৎসাহিত ছিলেন। গত জুলাই থেকে নতুন ব্যবস্থার ফলে সুদহার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। মেয়াদি আমানত রেখে এখন ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। আবার গত ডিসেম্বর থেকে ডলারে অ্যাকাউন্ট খুলে জমা রাখলে ভালো সুদ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স কেনার দরে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কড়াকড়ি করছে না। এসব কারণে যেসব প্রবাসী বা রপ্তানিকারক দেশের বাইরে ডলার ধরে রেখেছিলেন, তারা এখন আনতে শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে বাজারে সাময়িক একটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ব্যাংকিং চ্যানেলে ৪২৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৭৬ কোটি ডলার বা ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুর দিকে রেমিট্যান্স কম ছিল। যে কারণে সব মিলিয়ে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বেড়েছে মাত্র ১০৫ কোটি ডলার বা ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। এ সময়ে প্রবাসীরা মোট ১ হাজার ৫০৬ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১ হাজার ৪০১ কোটি ডলার।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথম আট মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি। আবার বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমদানি কমিয়ে রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছর আমদানি কমেছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারেন্সি সোয়াপ নীতিমালার আওতায় কয়েকটি ব্যাংক প্রায় ৭৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রেখেছে। আবার কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে না বললেই চলে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে গতকাল ২০ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গত সপ্তাহ শেষে যা ছিল ২০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। গত জানুয়ারি শেষে রিজার্ভ নেমেছিল ১৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারে। অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি সময়ের দায় শোধ করতে হবে। তাতে রিজার্ভ আবার কমবে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম সমকালকে বলেন, নির্বাচনের আগে মানুষ পর্যবেক্ষণ করছিল। এখন পর্যবেক্ষণ শেষ হয়েছে। যে কারণে রেমিট্যান্স বাড়ছে। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স আরও বাড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হতে হবে। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সারদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটা বড় খাত হতে পারে।
বেড়েছে নগদ ডলারের পরিমাণ
ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও চিকিৎসা, শিক্ষা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ডলার নেয় মানুষ। ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার থেকে এসব ডলার কিনতে হয়। বিভিন্ন ধরনের চার্জসহ ব্যাংকগুলো ১১৫ থেকে ১১৮ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করছে। আর মানি চেঞ্জার থেকে কিনতে খরচ হচ্ছে ১২৪ টাকা। নগদ ডলারের দর অনেক দিন ধরে এমন রয়েছে। যে কেউ বিদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাব খুলে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত জমা রাখতে পারবেন। এ ধরনের জমার ওপর সুদ মিলবে ৭ শতাংশের বেশি। গত ডিসেম্বরে এ সুযোগ দেওয়ার পর থেকে ব্যাংকের কাছে নগদ ডলার বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর কাছে সোমবার এ ধরনের জমার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি যা ২ কোটি ২৯ লাখ ডলার ছিল। আর গত জানুয়ারি মাসে ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। মূলত সুদ ও সুবিধার কারণে আগে দেশে ফিরে বাইরে বিক্রি করতেন বা নিজের কাছে রাখতেন এ রকম অনেকে এখন ব্যাংকে জমা রাখছেন। প্রসঙ্গত, এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলার ১০০ টাকার বেশি দরে কেনাবেচা হচ্ছে। গত দুই বছরে টাকার ব্যাপক দর পতন হয়েছে। এসবের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশির পাঠানো রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীর নামেও সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অ্যাকাউন্টে তিন মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে অর্থ রেখে ৭ থেকে ৯ শতাংশের বেশি সুদ দেবে ব্যাংক।
source: samakal.com
dollar market good exchange rate well